সাথে থেকো প্রিয় পর্ব ১
লেখক:রিয়ান আহমেদ
-‘আমার মতো শারীরিকভাবে অসুস্থ অনাথ মেয়েকে বিয়ে করার জন্য আপনি কেন পাগলামি করছেন?প্লিজ ছাদ থেকে নেমে আসুন।’
চিৎকার করে অনাথ আশ্রমের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনব নামের ছেলেটাকে অন্তি কথাটা বলল।অভিনব অন্তির কথায় কর্ণপাত না করে আবার বলল,
-‘যদি এই বিয়ে বন্ধ না হয় তাহলে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবেন আপনারা,,,অন্তিকা শুধুমাত্র আমার।’
সবার মাঝে কানাঘুষো শুরু হয়ে যায়।অন্তিকা রহমান ওরফে অন্তি চোখ ভিজে আসে এসব ঘটনা দেখে।আজ ‘আশার আলো’ অনাথ আশ্রমে অন্তির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল।অন্তির বয়স আজ আঠারো বছর তাই নিয়ম অনুযায়ী আঠারো বছর হওয়ার পর তাকে এখানে রাখা সম্ভব না।হয় সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় না হয় মেয়েটিকে কোনো চাকরি দেওয়া হয়। অন্তি তিন মাস আগে এইচএসসি দিয়েছে তাই সেই অনুযায়ী তাঁর চাকরির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল যেন সে উপার্জন করতে পারে।কিন্তু তিন মাস আগে হঠাৎ সিড়ি দিয়ে কোনোভাবে পড়ে গিয়ে অন্তি হাতে মারাত্মক আঘাত পায়।এতে করে অন্তির পক্ষে আর সেই চাকরিতে জয়েন করা বর্তমান সম্ভব নয়।অন্তির হাতের ট্রিটমেন্টের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন যা অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ চাইলেও দিতে পারবে না।তাই তাঁরা একজন সুপাত্র খুঁজে অন্তিকে বিয়ে দিতে চান যেন অন্তির চিকিৎসা করাতে পারে সেই ছেলে।কিন্তু চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায় তেমনই অন্তির জন্য কোনো সুপাত্রের দেখা মিলছিল না।কারণ একই তো অন্তি অনাথ আবার এখন তাঁর সাথে যোগ হয়েছে বাম হাতের প্রতিবন্ধকতা তাই হুরের মতো সুন্দর চেহারা থাকা সত্তেও তেমন ভালো পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না।এমতাবস্থায় আদিল মাহমুদ নামের এক ভদ্র, সুদর্শন ছেলে অন্তিকে বিয়ে করার এবং সুস্থ করে তোলার প্রস্তাব দেয়।সকলেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় কিন্তু আজ বিয়ের কার্যক্রম শুরু করার ঠিক আগের মুহূর্তে অভিনব নামের ছেলেটি এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল।অন্তি সবার নানান ধরনের কথায় অভিনবকে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
-‘দেখুন মিস্টার অভিনব আপনি এখানে প্লিজ আর তামাশা না করলে খুশি হবো।প্লিজ ছাদ থেকে নেমে আসুন আর নিজের রাস্তা মাপুন।’
অভিনব অবাক হয়ে বলল,
-‘তোমার কি আমাকে মিথ্যাবাদী মনে হচ্ছে।ওকে তবে আমি ছাদ থেকে এখনই লাফ দিচ্ছি।’
অভি নিজের একটা পা ছাঁদের বাইরে রাখতেই অনাথ আশ্রমের প্রধান পরিচালক জাবেদ খন্দকার চেঁচিয়ে বললেন,
-‘প্লিজ থামুন আপনি,,,আমরা আপনার সঙ্গে অন্তির বিয়ে দেবো প্লিজ নিচে নেমে আসুন।’
অন্তি আর আদিল অবাক হয়ে তাকায় জাবেদ খন্দকারের দিকে।অন্তি অবাক হওয়া কন্ঠে বলল,
-‘চাচা আপনি কিভাবে এমনটা বলতে পারেন?ওনার মতো একজন বড়লোক ব্যক্তিকে আমিরর পক্ষে বিয়ে করা কখনোই সম্ভব নয়,,,,তাঁর উপর উনি একজন মডেল আমি তাঁকে বিয়ে করতে পারবো না।’
আদিল রেগে গিয়ে বলল,
-‘কি বলছেন আপনি এসব?আমার সামনে আমার হবু স্ত্রীকে অন্য কেউ বিয়ে করবে?আমি এটা কখনোই মেনে নেবো না আমি অন্তিকেই বিয়ে করবো।’
জাবেদ খন্দকার অসহায় দৃষ্টিতে অন্তির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘মারে আমার কথাটা শোন প্লিজ তুই যদি এই বিয়ে না করিস তবে এই ছেলে কোনো একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে।অন্তি এই অনাথ আশ্রমের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।,,,প্লিজ রাজী হয়ে যা ছেলেটা তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসে হয়তো।’
অভিনব আবারো সকলের মাঝে নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য জোর গলায় বলে উঠলো,
-‘অন্তিকা আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।সারাটা জীবন তোমাকে এভাবেই ভালোবাসবো শুধু অনুরোধ একটাই সাথে থেকো প্রিয়।’
অন্তির কানে অভিনবর কথাগুলো এসে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ,’সাথে থেকো প্রিয়’ এই একটা কথা অন্তির মন এবং মস্তিষ্কে মুহূর্তেই তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।অন্তির কাছে অনাথ আশ্রমের সকলেই অভিনবকে বিয়ে করার জন্য রিকোয়েস্ট করতে থাকে।অন্তির ব্যাপারটা দেখে খারাপ লাগছে এই মানুষ গুলোকেই সে নিজের আপনজন মনে করে এসেছে বুঝ হওয়ার পর থেকে।মা বাবার মতো এনারাই ওর সব ছোট ছোট ইচ্ছে পূরণ করেছে আজ সেই মানুষগুলোকে ওর কাছে অনুরোধ করতে দেখে অন্তির মোটেও ভালো লাগছে না।অন্তি অনাথ আশ্রমের চারদিকে চোখ বোলায় অভিনব ওকে ভালোবাসে কিনা তা ওর জানা নেই তবে ও যে এই অনাথ আশ্রম আর এখানকার মানুষগুলোকে বড্ড বেশি ভালোবাসে তা ও জানে।
অভিনবর মতো এতো বড় মান্যগণ্য ব্যক্তির এখানে মৃত্যু ঘটলে নিশ্চিত এই অনাথ আশ্রমেরও খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু ঘটবে।অন্তি ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে শক্ত গলায় বলল,
-‘আমি রাজি মিস্টার অভিনবকে বিয়ে করতে।’
সবাই বলল,
-‘আলহামদুলিল্লাহ,,,,,মিস্টার অভিনব আপনি নেমে আসুন ছাদ থেকে অন্তি আপনাকে বিয়ে করতে রাজী।’
অভিনব খুশি হয়ে অন্তির দিকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে নিচে নেমে আসলো।আদিল রেগে লাল হয়ে বলল,
-‘কি হচ্ছেটা কি এখানে আমার সাথে যদি বিয়ে নাই দেয়ার ছিল তবে এতো নাটকের কি দরকার ছিল?’
অভিনবর পিএস বিধান বলল,
-‘এতো চেঁচিয়ে লাভ নেই।ম্যাডামের বিয়ে স্যারের সঙ্গেই হবে।এন্ড এখানে আপনার উপস্থিতিটাও এখন অবশ্যক নয় তাই নিজের রাস্তা মাপুন।’
আদিল পাগড়ি টাগড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের মানুষ জন নিয়ে চলে গেল।অভিনব এসে বিধানকে বলল,
-‘বিধান গাড়ি তৈরি তো তাই না?’
-‘জ্বী স্যার।’
-‘তাহলে চলো অন্তি বিয়েটা সেরে বাসায় রওনা হই কেমন?ঐ কাজি বিয়ে শুরু করেন।’
অভিনবকে কবুল বলতে বলা হলে অভিনব ফটাফট বলে দেয় তবে অন্তি বেশ সময় নেয়।বিয়ে সাদির পর্ব সেড়ে অভিনব অন্তিকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে নিলে অন্তির চোখ পড়ে অনাথ আশ্রমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একঝাঁক সাংবাদিকদের ওপর যাঁদের অভিনবর কিছু বডিগার্ড আটকে রেখেছে।অন্তি গাড়িতে উঠতে নিলে একজন সাংবাদিকের কথা কানে আসে,
-‘বিখ্যাত শিল্পপতি ও মডেল অভিনব খান বিজয় বিয়ে করেছেন অন্তিকা রাহমান নামক একজন অনাথ মেয়েকে।’
অন্তি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মনে মনে বলল,
-‘আজ থেকে তোমার জীবনে এরাও যুক্ত হলো অন্তি।তুই এদের না চাইলেও এরা এখন তোর জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ঢুকে পড়বে।কিন্তু তুই কি এদের কখনো চেয়েছিলে, নাকি কখনো অভিনব নামের এই সেলিব্রেটিকে লাইফ পার্টনার হিসেবে আশা করেছিলি?’
অন্তি গাড়ির এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে আর অভিনব গাড়ির অন্য কোনায় বসে কারো সঙ্গে কথা বলছে।
অন্তি অভিনবর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।এই তো কিছুক্ষণ আগের কথা অভিনব ওকে ভালোবাসে বিয়ে করে এনেছিল কিন্তু এখন সেই ব্যক্তি নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে এসে এমন আচরণ করছে যেন অন্তি নামক মেয়েটা তাঁর বউ নয় আর না এই বাড়িতে এই মুহুর্তে অবস্থান করছে।
কিছুক্ষণ আগেই অভিনব বাড়িতে ঢুকেই বড় বড় পা ফেলে নিজের দুই তলায় নিজের ঘরে চলে গেছে।হল রুমে যে তাঁর সদ্য বিবাহিতা বউ দাঁড়িয়ে আছে এতে তাঁর কোনো যায় আসে না।অভিনব তো অন্তিকে এটাও বলেনি অন্তিকে তার ঘরে যেতে হবে কি না।অন্তির দিকে তাকিয়ে বিধান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘নাহিদা!নাহিদা!’
একজন মাঝ বয়সী মহিলা ছুটে আসলো আর বলল,
-‘জ্বী স্যার বলুন।’
-‘ইনি হচ্ছেন স্যারের স্ত্রী মানে আপনাদের ম্যাডাম।ওনাকে ওনার ঘরটা দেখিয়ে দিন।আর হ্যা স্যারের খাবারের সময় হয়ে গেছে।ত্রিশ মিনিটের মধ্যে টেবিল তৈরি করুন।,,ম্যাম আপনি নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।’
অন্তি মাথা নাড়িয়ে নাহিদা নামক মহিলাটির সঙ্গে সেখান থেকে চলে গেল।অন্তি বুঝতে পারছে না ওর আর অভিনবর ঘর আলাদা কেন?কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও লজ্জা করছে তাই চুপ করে আছে।
খাবার টেবিলে বসে অন্তি অল্প একটু খাবার খেল যদিও সে আজ সারাদিন কিছুই খায়নি তবে নতুন জায়গায় এসে গোগ্রাসে গেলাও তো যায় না তাই ভদ্রতার খাতিরে বেশ কম খাবার খেয়ে উঠে দাঁড়ায় অন্তি।অন্তি উঠে দাঁড়াতেই অভিনবও উঠে দাঁড়ায় আর গম্ভীরভাবে অন্তির দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘আপনি এখনো এতো ভারি শাড়ি কেন পড়ে আছেন? ,,রুমে গিয়ে আলমারি থেকে জামাকাপড় নিয়ে চেন্জ করে নেবেন।একটু সোফায় গিয়ে বসুন আমার সঙ্গে আপনার বিয়ে নিয়ে আমি কিছু জরুরি কথা বলতে চাই।’
অভিনব এই পর্যন্ত ওকে তুমি বলে সম্বোধন করেছে তাই হঠাৎ আপনি বলাটা অন্তির কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।অন্তি চুপচাপ হাত মুখ ধুয়ে সোফায় গিয়ে বসে।কিছুক্ষণ বাদে অভিনব এসে অন্তির দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা প্লিজ পড়ুন আশা করি আপনি পড়াশুনা জানেন।’
অন্তি কথাটা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে এবার মুখ খুলেই ফেলল।
-‘কি মনে করেন কি আপনি আমাকে।আমাকে কোনদিক থেকে অশিক্ষিত, বর্বর, মূর্খ মনে হয়।’
অভিনব বোকা বনে চলে যায় এতোকিছু সে কখন বলল তবুও নিজেকে সামলে নেয় কারণ তর্কবিতর্ক করে লাভ নেই কথায় কথা বাড়বে।
-‘আপনি প্লিজ ফাইলে থাকা কাগজগুলো পড়ুন।’
অন্তি চুপ হয়ে যায় একে একে সবগুলো পৃষ্ঠা পড়ে ওর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা হয়।অন্তি ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না।এই মুহূর্তে ওর নিজেকে অভিনবর একটা ইনভেস্টমেন্ট মনে হচ্ছে।অন্তিকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে অভিনব নিজেই বলতে শুরু করলো,
-‘আমার দাদুভাই এর তৈরি এই কাগজগুলোর মতে আমি যদি আমার সাতাশ বছর বয়স হবার পূর্বে লিয়াকত শিকদারের নাতনি মানে আপনার নানার কথা বলছি তাঁর নাতনি অন্তিকা রাহমানকে বিয়ে না করি তবে আমার এই সব সম্পত্তি চ্যারিটিতে চলে যাবে।আমার বয়স কালকেই সাতাশ হবে তাই এক প্রকার নিজের সম্পত্তি বাঁচাতে জোরজবরদস্তি করে আপনাকে বিয়ে করেছি।আসলে আমার ড্যাড আর মম এতদিন আমাকে এই ব্যাপারে জানায়নি।তবে আপনি চিন্তা করবেন না আমি আপনার লাইফে কোনো ধরনের ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করবো না।আপনি আমার সম্পত্তি রক্ষা করতে আমাকে সাহায্য করেছেন তাই আপনি এর যথাযথ মূল্য পাবেন।আপনার হাতের ট্রিটমেন্টের দায়িত্ব আমার আর আপনি যদি সামনে সামনে পড়াশুনা করতে চান তাতেও আমি আপনার হেল্প করবো।আর আমরা দুজন দুজনের মতো থাকবো বুঝলেন যদি আপনার বা আমার মনে হয় আমাদের এক সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয় তখন আমরা ডিভোর্স দিয়ে দেব একে অপরকে।আর যাই হোক জীব,,,,,,,,।’
অভিনব কথাটা শেষ করতে পারে না তাঁর পূর্বেই অভিনবর মুখে একটা ঘুষি এসে লাগে হাওয়ার গতিতে।