সাথে থেকো প্রিয় পর্ব ৩৫
লেখক:রিয়ান আহমেদ
অন্তি নিজের বইয়ে মুখ গুঁজে ছিল।পড়ায় এতটাই মশগুল ছিল সে যে ঘরে সে ব্যতীত আরো একজন আছে এই বিষয়ে অন্তি অজ্ঞাত।
-‘এংগ্রিবার্ড তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’
অন্তি নীরব পরিবেশে হঠাৎ অভিনবর গলার শব্দে একটু ভয় পেল।সূরা পড়ে বুকে ফু দিয়ে সে চেয়ার ঘুরিয়ে অভিনবর দিকে তাকায় ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কথাটা শোনার উদ্দেশ্যে।অভিনব একটা টিউলিপ চেয়ার টেনে অন্তির সামনাসামনি বসে।
-‘তুমি আর কখনো মাহিরের সঙ্গে কথা বলবে না।’
-‘কেন?সে যেহেতু আমার শিক্ষক সেহেতু আমাদের মাঝে অনিচ্ছাসেত্ত্বও কথা হতে পারে।’
অভিনব মুখ শক্ত করে বলল,
-‘সেই সুযোগ থাকছে না যাইহোক আমরা আগামী সপ্তাহে সিঙ্গাপুর যাচ্ছি।’
-‘আমরা মানে?’
-‘আমরা মানে আমরা,,তুমি আর আমি যাচ্ছি।আমার ব্যবসায় সম্পর্কিত একটি কাজ আছে।’
-‘আপনার যেখানে ইচ্ছা আপনি সেখানে যান আমাকে টানছেন কেন?আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না এটাই আমার শেষ কথা।’
-‘তুমি যাবে আর তোমার জামাইও যাবে যাইহোক এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাইছি না।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি এরপর আমরা ডিনার করতে যাব।’
অভিনব আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেল।অন্তি স্টাডি রুমে সেভাবেই বসে রইলো।সে গালে হাত দিয়ে ভাবছে তার বইয়ের অঙ্কগুলো বেশি জটিল না কি অভিনবর মস্তিষ্ক।
অভিনব শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে।যেই সিদ্ধান্তই সে নিক না কেন ঠান্ডা মাথায় নিতে হবে।হামিম শিকদারকে সে অনন্তর বর্তমান অবস্থার কথা বলতে পারে নি কারণ সেটা তার গ্যাঙ্গের সঙ্গে জড়িত যাকে তাকে এই বিষয়ে খোলামেলাভাবে বলা যাবে না।এখন কথা হলো অন্তি যে কিনা ওর স্ত্রী এবং যার বর্তমান সে অভিনবর লিডারের মেয়ে।তাকে কি তার বাবার খোঁজ দেওয়া উচিত?অন্তিকে এই ব্যাপারে বললে তার ঠিক কি রিয়েকশন হবে?এছাড়া অনন্তকে কিভাবে বলবে তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই।
অভিনব সবশেষে সিদ্ধান্ত নিল অন্তির সঙ্গে এই বিষয়ে ইনডাইরেক্টলি বলবে এরপর যদি অন্তির রিয়েকশন কম খারাপ হয় তাহলে আসল সত্যটা বলবে।অন্তি অনন্তকে পিতা হিসেবে মেনে নিলেই অভিনব বাবা মেয়ের দেখা করাবে।কাজটা সময় নিয়ে করতে হবে।অনন্তকে এই ব্যাপারে এখন জানাবে না সে।যদি অন্তি নিজের বাবাকে মেনে না নেয় তাহলে অনন্ত স্ত্রী কন্যা দুজনের শোকে ব্রেইন ড্যামেজের শিকার হয়ে মারা যাবে।
অন্তি যদি নিজের বাবাকে মেনে নেয় তবে হয়তো অনন্ত সন্তানকে পেয়ে স্ত্রীর শোক কিছুটা হলেও কমাতে পারবে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
অভিনব আর অন্তি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।আজকে দুজনের মাঝে বেডে শোয়ার এরেন্জমেন্ট নিয়ে একটা চুক্তি হয়।অভিনব অর্ধেক বিছানা পাবে আর অন্তি অর্ধেক। তবে এর মাঝেও কাহিনী আছে অন্তি বলছে তাকে কম জায়গা দেওয়া হচ্ছে অভিনব বলছে তাকে কম জায়গা দেওয়া হচ্ছে।অবশেষে স্কেল দিয়ে পনেরো মিনিট যাবত দৈর্ঘ্য প্রস্থ মেপে বিছানা দুইভাগে তারা ভাগ করলো।অন্তি হাত দিয়ে অদৃশ্য রেখা টেনে অভিনবকে বলল,
-‘এইটুকু জায়গায় আপনি আসলে আমি আপনাকে বিছানা থেকে তুলে বারান্দায় রেখে আসবো আর টেরিকে আপনার জায়গায় শোয়াবো।’
-‘ওহ্ আমাকে উঠাবে!এই ক্যাঙারুর মতো শরীর নিয়ে আমাকে ওঠানোর কথা বলছো হাউ ফানি!এই দেখো আমার হাত আমি তোমার উপর রাখলাম পারলে সরিয়ে দেখাও।’
অভিনব অন্তির পেটে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে গলায় নাক ঘষলো।অন্তি কেঁপে উঠলো সে সরানোর চেষ্টা করলো অভিনবকে কিন্তু সফল হলো না এমনটা অভিনব সেদিনও করেছিল।অন্তি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো অভিনবকে আর এদিকে অভিনব নিজের সর্বশক্তি দিয়ে অন্তিকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে।অন্তির এখন নিজের ভুল কথাটার জন্য আফসোস হচ্ছে।অভিনবকে না এসব উস্কানিমূলক কথাবার্তা সে বলতো আর না অভিনব তার সঙ্গে এখন আঠার মতো লেগে থাকতো।অন্তি পাঁচ বার ছাড়তে বলে অভিনবকে কিন্তু অভিনব উত্তর দেয় না।কিছুক্ষণ পর অভিনব অন্তিকে বলল,
-‘তুমি আমার সম্পর্কে কি ভাবো?’
অন্তি রেগে বলল,
-‘আপনি একজন অতি অভদ্র,বাজে,স্বার্থপর লোক।ছাড়ুন আমায় নাহলে কামড়ে দেবো।’
অভিনব হেসে বলল,
-‘দেও কামড় আমিও তোমাকে কামড় কিস দেবো।’
-‘মানে কি?কামড় কিসটা আবার কি?’
-‘দেখো আমি প্রাক্টিক্যালি বোঝাতে পছন্দ করি তাই আসো।’
অভিনব অন্তির গালে হাত রাখতেই সে চেঁচিয়ে উঠলো।অভিনব চোখ বড় বড় করে ওর মুখ চেপে ধরে বলে,
-‘কি হচ্ছেটা কি?এভাবে চেচাও কেন?’
অভিনব অন্তির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।অন্তি বলল,
-‘আমাকে কোনো কিছু শেখাতে হবে না।’
-‘ওকে শেখালাম না।’
অভিনব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-‘আচ্ছা তোমার স্বপ্ন কি?জীবনে কোন জিনিসটা তুমি সবচেয়ে বেশি আশা করেছো?’
অন্তি সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ কি?’
-‘আরে বলো না,,,আমি কি পর নাকি?’
-‘সেটা আপনি ভালো জানেন যাইহোক প্রশ্ন যেহেতু করলেন উত্তরটা দেই।আমার স্বপ্ন একটা বেকারি এন্ড ক্যাফে খোলা সেখানে আমি নিজের হাতে তৈরি কেক,কুকিজ,ব্রেড কফি বিক্রি করবো।আর আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি কোনো জিনিসকে আশা করি নি একটা ভালোবাসায় ভরা পরিবার আশা করেছিলাম।যেখানে আমি আমার মা বাবার সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাবো।আমার মতে প্রত্যেকটা অনাথ শিশুর জীবনে এই আশাটা অবশ্যই থাকে।’
অন্তি কথাগুলো বলতে বলতে বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।তারা ভরা আকাশ আর থালার মতো চাঁদ দেখে সে হাসলো।এমন দৃশ্য কার না ভালো লাগে যদি সাথে থাকে প্রিয় মানুষটা।অন্তি এবার নিজেই অভিনবর একটু কাছে এগিয়ে এলো।মানুষটাকে যখন এই মুহুর্তে কাছে পেয়েছে তাহলে আর একটু কাছে যেতে দোষ নেই।পৃথিবীর মোহ মায়া বড় অদ্ভুত তবে এরচেয়ে বেশি অদ্ভুত হলো নরের প্রতি নারীর ভালোবাসা।এই ভালোবাসার জন্য পৃথিবীর বুকে বহু ইতিহাস লেখা হয়েছে।অন্তি জানে না তার ভালোবাসা ইতিহাস হবে কি না তবুও সে ভালোবাসবে।
এমন মানুষকে কে না ভালোবেসে থাকতে পারে?সবসময় কেয়ার করা আর মুখে সুন্দর হাসি ঝুলিয়ে রাখা এই বিষয়গুলো কি প্রেমে পড়তে কাউকে বাধ্য করবে না?
হঠাৎ অভিনব বলল,
-‘আচ্ছা যদি কখনো তুমি নিজের মা বাবাকে ফিরে পাও?’
অন্তি চমকে গেল কথাটায়।অন্তির চোখমুখ অমাবস্যার চাঁদের ন্যায় অন্ধকার হয়ে এলো।অন্তি মুখ ছোট করে বলল,
-‘এমনটা কখনো হবে না আমার মা না ফেরার দেশে আছেন আর আর আমার বাবা কোথায় আছে তা আমার জানার ইচ্ছে নেই।’
-‘কেন নেই?এমটাও তো হতে পারে সে কোনো এক বাজে পরিস্থিতির শিকার হয়ে তোমাদের থেকে দূরে আছেন।’
অন্তি রেগে গেছে।তার চোখ লাল হয়ে আছে আর কানও।সে রেগে অভিনবর দিকে ঘুরলো।দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।অন্তি শক্ত গলায় বলল,
-‘ইচ্ছে নেই কারণ আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ হবার নয়।আমার বাবা কোথায় তা আমি জানতে চাই না কারণ আমরা সামনাসামনি হলে হয়তো আমার হাতে ভুল কিছু হয়ে যাবে।উনি আমাদের ফেলে কাপুরুষের মতো গা ঢাকা দিয়ে চলে গেছেন।একজন মানুষের না হলে কোনো খোঁজ খবর কেন পাওয়া যাবে না।যে নিখোঁজ হয় তাকে খুঁজে বের করা যায় কিন্তু যে নিজে থেকে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।আমার জন্মদাতার জন্যই আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে বলে আমি মনে করি কারণ সে থাকলে আমার মাকে কখনোই নয় মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে বাজারে যেতে হতো না আমি নিজেকেও দায়ী মনে করি আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য।আমি তার গর্ভে না আসলে হয়তো সে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতো।তার জীবনে আরো চয়েজ থাকতো।’
অন্তি কথা বলার শেষের পর্যায়ে তার গলা কাঁপছিল।অন্তি নিজের কান্নাটাকে অনেক আটকাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।আপন মানুষগুলো পাশে থাকলে কান্না আটকানোটা বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।টেবিল ল্যাম্প আর ডিমলাইটের আলোয় অভিনব স্পষ্ট অন্তির চোখের জল দেখতে পাচ্ছে।অভিনব অন্তির মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে।অন্তি কান্নার গতি আরো বাড়ায়।অভিনব ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
-‘হুসস কান্না করো না তোমার মায়ের হায়াত ততটুকুই ছিল যতটুকু আল্লাহ্ ওনাকে দিয়েছিলেন তোমার এতে কোনো দোষ নেই।সে তোমাকে ভালোবাসে তাই তো নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন।’
অভিনবর অন্তির কথায় এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না যে অন্তি নিজের বাবা অনন্তকে অনেক বেশি ঘৃণা করে।অন্তি কাঁদতে কাঁদতে অভিনবর বুকেই ঘুমিয়ে যায়।
শুভ্র হাতের ঘড়ি দেখছে আর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে।সে ভীষণ বিরক্ত সারিকার উপর।মেয়েটার টাইম সেন্স বলতে কি কিছু নেই এতক্ষণ ধরে ওকে ওয়েট করাচ্ছে কেন?
আজ তাদের আউট অফ টাউন যেতে হবে।শুভ্র আর সারিকা একসাথে অফিস থেকেই রওনা হবে কিন্তু নয়টা দশ বাজে এখনো সারিকার আসার খবর নেই।কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল সারিকা আসছে সাথে একটা কালো লাগেজ।সারিকা এসে বলল,
-‘কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
-‘আমার চোখ কিভাবে তাকাবে সেটা আমার ইচ্ছা তবে তুমি যদি বিয়ের রেজিস্ট্রিতে সাইন করে আমার লাইফ পার্টনার হয়ে যাও তাহলে আমি সত্যি বলছি তুমি বাদে অন্য কোনো মেয়ে কি ছেলের দিকেও তাকাবো না।’
-‘যত্তসব এখানেও ফ্লার্টিং শুরু করেছে।আপনি না বলছিলেন পার্সোনাল লাইফ আর প্রফেশনাল মিক্স যারা করে তারা আনপ্রফেশনাল এখন আপনি কি করছেন?’
-‘দেখো আমি তোমার সঙ্গে পার্সোনালি ফ্লার্টিং করছি বুঝলি।আর আমাদের দুজনের মাঝে এখন বস আর এম্প্লই এর সম্পর্ক না এখন আমাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক।’
সারিকা বিড়বিড় করে বলল,
-‘এই পাগলের সাথে কথা বলতে গেলে পাবনা থেকে পাগলের ডিগ্রি আনতে হবে।’
সারিকার লাগেজ গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার পর সেও গাড়িতে উঠে বসে।দুজনে রওনা হয় লম্বা একটি সফরে।বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জেলা পঞ্চগড় এখন তাদের গন্তব্য।
সারিকা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সব গুছিয়েছে তাই তার এখন ঘুম পাচ্ছে।সারিকা একটু ঘুমে ঢুলে পড়ে আবার চোখ কচলে সোজা হয়ে বসে।এমন কাহিনী বেশ অনেকটা সময় যাবত চলছে।শুভ্র এবার বলল,
-‘আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে পারো।’
সারিকা ভাব নিয়ে বলল,
সাথে থেকো প্রিয় পর্ব ৩৪
-‘নো থ্যাংকস।’
-‘দেখো আমার কাঁধে মাথা রাখলে তোমার ক্ষতি হবে না বরং লাভ হবে।’
-‘কি লাভ?’
-‘দেখো আমার মতো একটা হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যানের ঘাড়ে মাথা রাখতে পারছো এটা হচ্ছে বড় একটা লাভ এরপর ধরো তুমি পড়ে গেলে আমি তোমাকে ধরবো আর কি চাই বলো।’
-‘নিজের লাভ নিজের কাছে রাখুন।আপনি আর অভি একেবারে একরকম নিজের ঢোল নিজে পিটান।’
-‘আমার তো ঢোলই নেই।’
-‘আমি প্রশংসা করার কথা বলেছি।’
সারিকা একটা সময় গাড়ির জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেল।সে বার বার ব্যাথা পাচ্ছে তাই শুভ্র সারিকার মাথাটি নিজের কাঁধে রাখলো সারিকা সরে যাওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-‘ছাড়ুন আমাকে ছুয়েছেন কেন?’
শুভ্র আরো কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
-‘ভালোবাসি তাই।’