সাথে থেকো প্রিয় পর্ব ৭
লেখক:রিয়ান আহমেদ
পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের মনে জীবনে একবার না একবার নিজের জীবনের অতীতকে বদলানোর ইচ্ছে অবশ্যই জাগে।অতীতের কষ্টের বেড়াজালে যাঁরা আটকে থাকে তাঁদের মনে এই ইচ্ছেটা একবার নয় হাজারবার আসে।অভিনব নিজের অতীতকে পেছনে ফেলে এসেছে ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝেই সেও একবার পেছন ফিরে অতীতের কষ্টের দিনগুলোকে একবার দেখে নেয়।কারণ আজকের অভিনবর জন্মই তো সেই অতীতটা থেকে।নিজের বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব না।
অভিনব বারান্দায় গাছে পানি দিতে দিতে এই কথাগুলোই ভাবছিল।সাদা গোলাপের গাছটাকে একটু ছাঁটাই করে অভিনব উঠৈ দাঁড়ায়।অন্তিকে বাড়িতে আনা হয়েছে আজ।না জানি কি করছে মেয়েটা যদিও একজন নার্স আছে তাঁর সাথে তবুও অভিনবর চিন্তা হচ্ছে মেয়েটা ভয়ংকর জেদী ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না।
অভিনব রুমের বাইরে পা রাখতেই নাহিদা অভিনবর কাছে এসে বললেন,
-‘স্যার বড় স্যার আর বড় ম্যাম এসেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
-‘যাও আমি আসছি।’
সোফায় পায়ে পা তুলে বসে আছেন অর্ণব খান এবং সুহানা খান দুজনের গম্ভীর চেহারাটায় ভয়ংকর রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।অভিনব গলা ঝেড়ে বলল,
-‘মম ড্যাড হ্যাভ সাম স্ন্যাক্স।’
সুহানা চেতে গেলেন ছেলের কথায় এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ছেলেটা এত স্বাভাবিক আচরণ কিভাবে করতে পারে।সুহানা রাগী গলায় বললেন,
-‘অভি তোমার কি বিন্দুমাত্র আফসোস নেই নিজের কাজের জন্য?কিভাবে এত স্বাভাবিক হতে পারছো তুমি?আমরা এক সপ্তাহ যাবত বাংলাদেশ এসেছি এই এক সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকে খান ম্যানশনে যাওয়া তো দূরের কথা একটা ফোন পর্যন্ত করো নি।এরপর আমরা যখন ফোন করলাম তখন রিসিভ পর্যন্ত করো নি,,,এতগুলো অপরাধ করেও তুমি ক্ষমা না চেয়ে চুপচাপ কিভাবে বসে থাকতে পারো?’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
-‘আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম ওর একটা সার্জারি করানো হয়েছিল যাঁর কারণে আমি তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারি নি আম সরি।’
অর্ণব রেগে গিয়ে বললেন,
-‘স্ত্রী কীসের স্ত্রী তুমি কি ভেবেছো একটা অনাথ,লো ক্লাস মেয়েকে আমাদের বাড়িতে বউ করে নিয়ে আসবে আর আমরা মেনে নেব নেভার।তুমি ভুলে যেও না আমরা তোমার বাবা মা।’
-‘দেখো প্রথমত ও কোনো লো ক্লাস মেয়ে নয় ও আমার স্ত্রী এন্ড এই বিয়েতে আমার মতামতটা সবার আগে জরুরি তোমার কিংবা মমের নয়।’
-‘ঐ মেয়েটাকে তুমি শুধুমাত্র ঐ উইলের কারণে বিয়ে করেছো বুঝলে আমি খুব ভালো করে জানি এই বিয়েতে তোমার মতামতও ছিল না।'(অর্ণব)
-‘ওকে করলে করেছি সো হোয়াট আমার লাইফ আমার ইচ্ছা আমি কি করবো না করবো।আমি এখন কোনো বাচ্চা নই যে তুমি আমাকে যা বলবে আমার তাই করতে হবে।’
সুহানা ছেলের কথা শুনে কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।তবে নিজের গোপন সূত্রে জানতে পেরেছেন অন্তি নামের মেয়েটাও অভিনবর সঙ্গে থাকতে রাজি নয়।সুহানা মুখ ফুটে বলেই ফেললেন,
-‘অন্তিকা কি তোমার সঙ্গে থাকতে রাজি?’
অর্ণব তাচ্ছিল্য করে বললেন,
-‘রাজি হবে না আবার কোটিপতি ছেলে পেয়েছে কোনো ধরনের স্ট্যাটাস না থাকা সত্তেও।এইসব মেয়েদের আমি ভালো মতো চিনি।’
অভিনবর মাথা গরম হয়ে গেল এমন কথা শুনে।কথাটা পুরোপুরিই অন্তি এমন মেয়ে একদমই নয়।অভিনব রেগে গিয়ে বলল,
-‘ড্যাড কারো সম্পর্কে না জেনে এমন কথা বলবে না।’
-‘তুমি আমাকে শেখাতে আসবে না আমার কি করা উচিত আর কি করা উচিত না।সুহানা চলো এখান থেকে আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না।’
সুহানা অর্ণবকে বললেন,
-‘তুমি যাও আমি অন্তিকার সঙ্গে একবার দেখা করে আসছি।’
অর্ণব রাগে ফসফস করতে করতে বললেন,
-‘যা ইচ্ছা তাই করো আমি যাচ্ছি।’
অন্তি টিভিতে নিউজ দেখছে আধ শোয়া হয়ে।জীবনে সুখ নামক জিনিসটা সে কখনোই দেখেনি ভেবেছিল হয়তো কষ্টের পর একদিন না একদিন সুখের দেখা মিলবে কিন্তু জীবনের আঠারোটি বছরেও তা সম্ভব হয় নি আর অভিনবর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তো এখন সেই আশাটাও অন্তি ত্যাগ করেছে।অন্তিকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেওয়া হয় যখন তাঁর বয়স চার বা পাঁচ।এরপর কয়েক বছর কেটে যায় অন্তিও ধীরে ধীরে বড় হয় কিন্তু তাঁকে কেউ এডপ্ট করতে চায় না।প্রথমত যাঁরাই বাচ্চা দত্তক নিতে আসতো তাদের মধ্যে অধিকাংশরাই চাইতো দুধের বাচ্চা। যদি বেশি ছোট বাচ্চা না থাকতো তখন ভালো একটা ছেলে সন্তান তাঁরা দত্তক নিতো।আর অন্তি যত বড় হতে থাকে ততই তাঁর বাবা মা পাওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে শুরু করে।একটা সময় অন্তির পৃথিবীর সকল বাবা মায়ের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে।অন্তি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে নিজের বাবাকে।অন্তির আজ এই মুহূর্তে এতগুলো কথা মনে পড়ার কারণটা হলো মাত্র সে নিউজে দেখলো একটা দুইদিনের নবজাতক কন্যা সন্তানকে বাস স্ট্যান্ড ফেলে চলে যাওয়া হয়েছিল।বর্তমানে বাচ্চাটি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছে।ডাক্তাররা বলেছেন বাচ্চা একদম সুস্থ সবল।স্বাস্থ্য একদম ঠিক আছে,গাঁয়ের রং শ্বেত বর্ণের তাঁরা ধারণা করছেন বাচ্চাটা কোনো স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান।অন্তি মনে মনে বলল,
-‘বাচ্চাটাকে ফেলে চলে যাওয়ার কারণ কি?,,,তাঁকে তাঁর পরিবারের লোক কি কারণে বঞ্চিত করলো,,,সে মেয়ে বলে?,,জানি না কিন্তু আল্লাহ্ যেনো বাচ্চাটাকে এবার একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবার দেয়।যেখানে মেয়ে বলে তাঁকে বোঝা নয় জান্নাত মনে করা হয়।’
হঠাৎ খট করে দরজায় শব্দ হতেই অন্তি দরজার দিকে তাকায়।একজন মাঝবয়সী সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে গোলাপি শাড়ি পড়ে।অন্তি সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই সুহানা হাতের ইশারায় বললেন,
-‘দরকার নেই।’
অন্তি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলো,
-‘আপানি কে?’
-‘আমি সুহানা খান অভির মা।’
-‘জ্বী আসসালাম ওয়ালাইকুম আন্টি।’
-‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
সুহানা বেডরুমের সোফায় বসে বললেন,
-‘তুমি কি আমার ছেলের সঙ্গে সংসার করতে চাও?’
-‘জ্বী না আমি ওনার কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তি চাই।’
-‘কিন্তু কেন?আমার ছেলের টাকা আছে,খ্যাতি আছে,সে দেখতেও মাশাল্লাহ কোনো রাজকুমারের চেয়ে কম না তাহলে তার সঙ্গে ঘর করতে সমস্যা কোথায়।’
অন্তি হেসে বলল,
-‘আন্টি একটা সম্পর্কে যদি ভালোবাসা না থাকে তাহলে তা চালিয়ে যাওয়া মানে নেহাত একটা বোকামি।আর বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে তো সেটা অসম্ভব।আপনি বললেন আপনার ছেলের টাকা আছে কিন্তু একটা কথা কি জানেন আজ যদি সে অফিসের কোনো কেরানিও হতো কিন্তু দিন শেষে আমাকে শুধু ভালোবাসতো তবে আমি তার তাঁর সঙ্গে থেকে যেতাম।যদি সে দেখতে সবচেয়ে কুৎসিৎ ব্যক্তি হতো কিন্তু আমাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতো আমি তাঁর সঙ্গে থেকে যেতাম,,,আপনাদের কাছে হয়তো কথাগুলো নাটকীয় লাগতে পারে কিন্তু আমিই শুধু জানি এই কথাগুলোর মূল্য আমার কাছে কতটা।আমি অভিনবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কখনো আমাকে ভালোবাসতে পারবে কি না কিন্তু তাঁর উত্তর ছিল সে ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না।এমন একজন মানুষ যে ভালোবাসায় বিশ্বাস পর্যন্ত করে না তাঁর কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
সুহানা অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
-‘আজ আসছি।’
-‘আপনারা কি একসাথে থাকেন না?’
-‘না।’
কথাটা বলে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।সুহানা মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বললেন,
-‘আমার ছেলে একটা খাঁটি হীরা বিয়ে করে এনেছে।একদিন ঠিক ও এই মেয়ের কদর বুঝবে।’
-‘হ্যালো মিস আপনি কি আমার কথা শুনতে পারছেন।’
-‘জ্বী পারছি কিন্তু আপনি কে?এতো রাতে আমাকে কেন ফোন করেছেন?'(সারিকা)
-‘আচ্ছা শোন আমি সে যাঁর তোমার সঙ্গে টম এন্ড জেরির মতো সম্পর্ক।’
-‘ আপনার কথার মানেটা কি?দেখুন আমার ভালো লাগছে না এই সময় কথা বলতে কোনো কাজের কথা বলতে হলে বলুন না হয় আল্লাহ্ হাফেজ।’
ফোনের ওপাশ থেকে শুভ্র এবার রেগে বলল,
-‘আরে আমি শুভ্র বলছি।শুভ্র শাহেদ খান,,,আমি ছাড়া কয়জনের সঙ্গে তোমার টম এন্ড জেরির মতো সম্পর্ক।’
সারিকা অবাক হলো।শুভ্র তাঁকে এত রাত করে ফোন দিয়েছে রাত সাড়ে এগারোটা কি এইসব ফালতু কথার সময়।সারিকা এক মিনিট নীরবতা পালন করে বলল,
-‘জ্বী স্যার বলুন কি সমস্যা?’
-‘আরে সমস্যা আমার না আমার ভাগিনার,,,আমার বোনের ছেলে পিটুস গল্প শুনতে চাইছে।’
সারিকা ক্লান্ত গলায় বলল,
-‘হুম তো আমি কি করবো?’
-‘দেখো আমি কোনো গল্প পারি না আমার বোন আর দুলাভাই দেশের বাইরে গেছে।তাই পিটুশ আজকে আমার কাছে শুতে চাইছে তাই বলছি কি তুমি একটু গল্প শোনাতে পারবে?’
সাথে থেকো প্রিয় পর্ব ৬
-‘আমি পাগল না কি এত রাতে আপনার জন্য গল্প বলতে বসে আছি।যান ইউটিউবে কোনো ফেইরি টেল বের করে ঘুম পাড়ান।’
-‘আরে চেষ্টা করেছি কিন্তু মোবাইলে একটার পর একটা দেখতেই থাকে ঘুমাতে চায় না।তাই প্লিজ,,,।’
-‘নাহ পারবো না রাখছি।’
-‘ওয়েট কেটে দিলে আমি বারবার কল করবো।’
-‘আমি সুইচড অফ করে রাখবো।’
শুভ্র আবার অনুরোধ করে বলল,
-‘প্লিজ একটা ছোট বাচ্চার ঘুমের ব্যাপার।’
সারিকা বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘রাতের বেলা কি আমাকেই পেয়েছিলেন না কি?’
-‘হ্যা আসলে বাংলাদেশে আমার আর কোনো চেনা পরিচিত মানুষ নেই তো।’
সারিকা আর তর্ক করতে পারবে না কারণ তাঁর চোখে রাজ্যের ঘুম সারিকা বাধ্য হয়ে বলল,
-‘আচ্ছা দেন।’
সারিকা পিটুশকে গল্প শোনাতে শোনাতে পিটুশকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ফোন না কেঁটে ঘুমিয়ে পড়লো।শুভ্র সারিকাকে কয়েকবার ডেকে বুঝতে পারলো সারিকা এখন স্বপ্নের পৃথিবীতে আছে তাই সে ফোন কেঁটে দিল।