শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪৪
ফাবিহা নওশীন
দূর মসজিদ থেকে এশার আজানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পরপর আশেপাশের সব মসজিদ গুলো নামাজের আহবান জানাতে শুরু করে দিয়েছে। ঘরে হালকা আলো জ্বলছে। মুখের উপরে হাত দিয়ে বিছানার মাঝে ছোট্ট মিশান ঘুমিয়ে আছে। তূর্জ মিশানের পাশে বসে ওর দিকে চেয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। তূর্জের বুকটা হু হু করছে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।
মিশান কেঁদে-কেটে সবেমাত্র ঘুমিয়েছে। ওর দাদি ওকে ফিডার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে মাহিকে মনে মনে বকতে বকতে কিচেনে গেল।
তূর্জের বাড়ির কেউই আসল ঘটনা জানে না। তূর্জ বলেছে মাহি মিশানকে ওর কাছে রেখে একটা কাজে গেছে। আসতে অনেক রাত হবে। কেউ যেন ওর জন্য টেনশন না করে। তূর্জ কাউকে কিছু বলতে চায় না। সকাল হলেই মিশানকে মাহির কাছে দিয়ে আসবে আর মাহির বাবা-মাকে সব বলে আসবে। তারপর বাড়িতে এসে সবাইকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলবে। তখন রাগের মাথায় মাহির কাছ থেকে মিশানকে কেড়ে রাখলেও এখন কাজটা অনুচিত মনে হচ্ছে। বাবা সন্তান ছাড়া থাকতে পারলেও মা পারে না। তেমনি দুধের বাচ্চার জন্য বাবার চেয়ে মায়ের প্রয়োজন অধিক। তাই সকাল হলেই ও বাড়িতে মিশানকে দিয়ে আসবে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
তূর্জ বারান্দায় গেল। ওর দৃষ্টি বাগান আর গেটের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুমিও দুধের বাচ্চাকে রেখে নিশ্চিন্তে চলে গেলে? একবারের জন্য খোঁজ নিলে না?”
তূর্জের মাথায় হুট করে আরেক ভাবনা উদয় হল,
“আচ্ছা, মাহি যাবার পর ও বাড়ি থেকে কোন ফোন এলো না কেন? মিশানকে রেখে দিয়েছি এ নিয়ে ওদের কারো কোন অভিযোগ নেই? অন্তত বাবার কাছে তো একটা ফোন আসার কথা। কেন আমি মিশানকে রেখে দিয়েছি?”
গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন
এসব ভাবনার মাঝে ফোন বেজে উঠল। ফোনটা ঘরে রেখে এসেছে। কে ফোন করেছে, কেন করেছে এ-সব জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তবুও ফোন রিসিভ করার জন্য ছুটে ঘরে গেল। কারণটা হচ্ছে মিশান ফোনের রিংটোনের শব্দে জেগে যেতে পারে।
তূর্জ নাম্বার না দেখেই দ্রুত ফোন রিসিভ করল।
ফোন কানে দিতেই ও পাশ থেকে বলে উঠে,
“ভাইয়া, আপুর ফোন অফ কেন? বাড়িতে পৌছে একবারও ফোন করল না। আমরা আপুর ফোনের অপেক্ষা করছি। ফোন অফ তাই আপনাকে ফোন করলাম। আপু কই?”
তূর্জ কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোনের স্কিনে তাকাল। মেহেরের কল।
আপু কই বাক্যটা শুনে তূর্জের কেমন ভয় লাগছে। মাহি এখনো বাড়ি ফিরে নি তাহলে কই? তূর্জ কানে ফোন নিয়ে বারান্দায় এলো। রেলিঙ ধরে নিচের দিকে ঝুঁকে আশেপাশে দেখল। কিন্তু কোন মানুষের চিহ্নও নেই।
মেহের তূর্জকে চুপ দেখে বলল,
“তূর্জ ভাইয়া!! চুপ কেন? কথা বলছেন না কেন? আপুকে দিন মা কথা বলবে।”
তূর্জ চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে বলল,
“তোমার আপু তো এখানে নেই।”
মেহের কানে ফোন নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় ওর মায়ের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“নেই মানে? আপু কোথায় তাহলে? আপু দুপুরের খাবার খেয়েই বের হয়েছে সে মতে আপনাদের বাড়িতে ৪টায় পৌছে যাবার কথা। আর এখন রাত ৮টা বাজতে চলল। তাহলে আপু কোথায় গেছে?”
তূর্জের বুকে মোচড় দিয়ে উঠল অজানা আতংকে। মাহি বাড়িতে না গেলে গেল কোথায়? তূর্জ দ্রুত ঘর থেকে বের হচ্ছে আর ফোনে বলছে,
“আমি জানি না মেহের মাহি কোথায় গেছে। এখন তো আমারও টেনশন হচ্ছে।”
মেহেরের মা মেহেরের আতংকিত চেহারা আর বিচলিত কথা শুনে ওর পাশে এসে বসে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে? মাহি ঠিক আছে তো?”
মেহের ইশারা করল পরে বলবে।
“আপু আপনাদের বাড়িতে না গেলে মিশানকে নিয়ে কোথায় গেল? ওদের কিছু হয় নি তো? আল্লাহ! মিশান ঠিক আছে তো? আমার তো টেনশনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তূর্জ বাড়ির বাইরে এসে মাহিকে খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“মিশান আমার কাছে। আমার পুরো কথা শুনো, মাহি মিশানকে নিয়ে এসেছিল। আমি মাহিকে বাড়িতে ঢুকতে দেই নি। আমি ভেবেছি ও বাড়িতে চলে গেছে।”
মেহের হয়ে বলল,
“এটা আপনি কি করেছেন ভাইয়া? আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। এমন একটা কাজ কি করে করলেন? মিশানকে রেখে আপুকে বের করে দিয়েছেন? আপনার বিবেকে বাঁধল না? হার্টলেসের মত কাজ করেছেন। আপুকে চিনেন না? আপুর ফোন সুইচড অফ আসছে। জানি না আপু ঠিক আছে কি না। না নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলেছে।”
তূর্জ বলল,”নাহ! মেহের এভাবে বলো না। আমি মাহিকে খোঁজে বের করব। মাহির কিছু হবে না। কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তখন আমি রাগের মাথায় এটা করেছি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই ভাবছিলাম সকাল হলেই মিশানকে দিয়ে আসব।”
মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আপুকে খোঁজে এনে দিন। নয়তো আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না।”
তূর্জ চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে ডাকল। তূর্জের চিৎকার শুনে তূর্জের বাবা-মা আর বোন ছুটে এল। তূর্জ ওর মা’কে দেখে বলল,
“মা, মিশানের খেয়াল রেখো। মাহিকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ওকে খুঁজতে যাচ্ছি।”
তূর্জের মা ওর কথা কিছুই বুঝতে পারছে না।
“তুই না বললি মাহি একটা কাজে গেছে। ওকে খোঁজে পাওয়া যাবে না কেন? কার সাথে গিয়েছে? আর এ-সব…
” মা, আমি ফিরে এসে সব বলব। এখন আমার হাতে সময় নেই।”
গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন* তূর্জের মা বলল,
“আচ্ছা বাবা যা, সাবধানে যাস। সমস্যা হলে ফোন করিস। চিন্তা করিস না পেয়ে যাবি।”
তূর্জের বাবা বলল,
“আমি আসব তোর সাথে?”
তূর্জ গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল,
“না বাবা, তোমাকে যেতে হবে না। দরকার পড়লে আমি ফোন করব।”
তূর্জ এদিক সেদিক খোঁজে যাচ্ছে। কানে ফোন নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মাহির পরিচিত বন্ধুবান্ধব যাদের পাচ্ছে ফোন করছে আর বারবার গাড়ির বাইরে রাস্তায় চোখ বুলাচ্ছে।
গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন*
ফায়াজ ঘরে ঢুকে মেহেরের মা’কে ফোনে কথা বলতে দেখছে। উনি কাঁদছেন। বিছানার দিকে তাকিয়ে মেহেরকে বসে বসে কাঁদতে দেখল। ফায়াজ মেহেরকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ মেহেরের কাছে গিয়ে অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“মেহের, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
মেহের হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
“না, আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
ফায়াজ অবাক হয়ে বলল,
“কিহ! মাহিকে পাওয়া যাচ্ছে না? ও তূর্জের বাড়ি যায় নি?”
মেহের ফায়াজকে সব খুলে বলল। ফায়াজ সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন
মেহের ফায়াজকে অনুরোধের সুরে বলল,
“কিছু করুন না। কত রাত হয়ে যাচ্ছে। আপু এত রাতে কোথায় আছে? কেমন আছে? প্লিজ কিছু করুন।”
ফায়াজ মেহেরকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“তুমি কান্নাকাটি থামাও। দেখছি কি করা যায়। আমি তূর্জ ভাইয়াকে আগে ফোন করে জানি বিষয়টা কতদূর গড়িয়েছে।”
ফায়াজ তূর্জকে ফোন করে কি যেন কথা বলল। তারপর বেড়িয়ে গেল। গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন*
মাহি একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সুনসান নীরবতা চারদিকটা গ্রাস করে ফেলেছে। হুটহাট শাই শাই করে দু-একটা প্রাইভেট কার ছুটে যায়। তাতে পরিবেশটা আরো ভয়ানক হয়ে উঠে। মাহির শরীর কেঁপে উঠে। কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। চারদিক নিষ্প্রাণ। গত কয়েকদিন ধরে পূর্ণিমা থাকলেও আজ চারদিকটা অন্ধকার।
মাহি ফোনের আলো জ্বালাল। এরোপ্লেন মুড অফ করল। তারপর আবার ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকাল।
“আমি যদি আজ মরে যাই তাহলে কেউ কষ্ট পাবে? কে কষ্ট পাবে? বাবা-মা, বোন, স্বামী সবাই আমাকে ঘৃণা করে। তূর্জ তো ওর জীবন থেকে আমাকে সরিয়েই দিয়েছে। বাবা-মায়ের কাছে ফিরব কোন মুখে? আমার ছেলেটা? ওর কি হবে? ও তো মা হারা হয়ে যাবে? ওকে দেখার কে থাকবে? আমাকে কি ওর প্রয়োজন হবে? না ওর বাবাই যথেষ্ট হবে?”
মাহি কিছু ভাবতে পারছে না। এই মুহুর্তে মরার কথা ভাবলেও কেন জানি পারছে না। মাহি মেহেরকে ফোন করল।
মেহের মাহির ফোন পেয়ে খুশিতে হেসে ফেলল। ওর চোখমুখ চকচক করছে।
“আপু ফোন করেছে!”
মেহের ফোন রিসিভ করে বলল,
“আপু তুমি কই? তোমার জন্য সবাই কত টেনশন করছি। বাড়িতে আসো। আর নয়তো বলো কোথায় আছো?”
মাহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“মেহু, আমি যদি মরে যাই তাহলে আমার ছেলেটাকে তুই দেখবি?”
মেহের মাহির কথা শুনে হতবাক। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল কিছু বয়ে গেল। কি আবল তাবল বলছে।
“আমি অনেক অন্যায় করেছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
“আপু….
মাহি ফোন কেটে দিল। ফোনের আলো নিভে গেল। ওর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে।
মেহের আবার ফোন করল মাহির নাম্বারে। না পেয়ে ফায়াজকে ফোন করল।
” আপু খারাপ কিছু করার কথা ভাবছে। কিছু করুন। অনেক ভয় লাগছে।”
ফায়াজ বলল,
“মেহের, আমি কিছু করছি। ভয় পেও না কিছু হবে না।”
ফায়াজ মাহির নাম্বার পরিচিত একজনকে দিয়ে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকেশন জানাতে।
ফায়াজ তূর্জকে কিছু জানাল না। তূর্জ আরো টেনশন করবে। তাই ওকে জানাল না।
কিছু সময় পর তূর্জকে ফোন করে একটা লোকেশনে আসতে বলল।
গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন
ফায়াজ ব্রিজে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে মাহিকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাহিকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফায়াজের ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। মাহি ভুলভাল কিছু করে ফেলে নি তো? হটাৎ ফায়াজ একটা মেয়ের অববয় দেখতে পেল।
মাহি ব্রিজ থেকে নিচের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। খুব ভয় লাগছে। মাহি ঢোক গিলছে।
ফায়াজ মাহির নাম ধরে ডাকল। মাহি নিজের নাম শুনে চমকে পেছনে তাকাল। ফায়াজকে দেখে অবাক হল। ফায়াজ দৌড়ে মেহেরের কাছে গিয়ে বলল,
“কি মেয়ে তুমি হা? সবাইকে টেনশনে ফেলে এখানে কি করছো?”
মাহি কিছু বলতে পারছে না। ওর ফেস থেকে ভয়ের রেশ কাটে নি। ফায়াজ মাহিকে বকাবকি করছে। এর মধ্যে তূর্জের গাড়ি চলে এল। তূর্জ গাড়ি থেকে নেমে মাহিকে দেখে দৌড়ে এল। মাহি তূর্জকে দেখে চোখ বড়বড় করে ফায়াজের দিকে তাকাল। তূর্জ আর সময় দিল না। মাহিকে জড়িয়ে ধরল।
ফায়াজ ওদের এভাবে দেখে অন্যদিকে ঘুরে হাঁটা দিল।
মাহি তূর্জের বুকের ধুকধুকানি স্পষ্ট অনুভব করছে। কেউ কোন কথা বলছে না। তূর্জ অনেকক্ষণ পর মাহিকে ছেড়ে দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে বলল,
“মাহি তুমি কেন এমন করো? তুমি কি ঠিক করে রেখেছো সব সময় আমাকে কষ্ট দেবে? আমি রাগের মাথায় কি বললাম আর তুমি সব ছেড়েছুড়ে এখানে…..
” আমি কি করতাম তূর্জ? তোমার চোখে আমার প্রতি যে ঘৃণা দেখেছি সেটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।”
গল্পের রাইটার ফাবিহা নওশীন
“শুধু ঘৃণাই দেখলে, ঘৃণার কারণ আর ঘৃণার আড়ালে ভালোবাসাটা দেখলে না? কারো ঘৃণা দেখার আগে সেই ঘৃণার কারণ আর আড়ালে লুকানো ভালোবাসা অনুসন্ধান করতে হয়।”
“তুমি বলেছিলে চলে যেতে তাই চলে এসেছি। আমার আর ভালো লাগছিল না সবার অবহেলা। তাই সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম।”
“আর তোমার ছেলে?”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪৩
“ওর কথা ভেবেই আমি কিছু করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমার চলে যাওয়া মানে এই নিষ্ঠুরতম পৃথিবীতে ওকে একা ফেলে যাওয়া।”
তূর্জ বলল,
“মিশান একা নয় ওর সাথে ওর বাবা-মা আছে। চলো বাড়ি চলো।”
“তার আগে বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো?”
“হ্যাঁ দিয়েছি। অতীত ভেবে ভবিষ্যত নষ্ট করতে চাই না।”
মাহি তূর্জের সাথে বাড়িতে চলে গেছে। ফায়াজ বাড়িতে ফিরে মেহের আর মেহেরের মা’কে সব জানাল।
মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। মিষ্টি হেসে ফায়াজকে বলল,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার উছিলায় আপুকে পেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ।”
ফায়াজ মাথা চুলকে বাকা হেসে বলল,”এসবে আমার পুষায় না মেহেরজান।”