শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪৬
ফাবিহা নওশীন
সকালের কাঁচা সোনা রোদ সকালের স্নিগ্ধতা বাড়িয়ে তুলছে। গাছে গাছে থোঁকা থোঁকা ফুল ফুটেছে। ফুলে ফুলে মৌমাছিরা মধু আহরণে ব্যস্ত। স্নিগ্ধ বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাগানের বড় গাছটায় পাখিরা কিচির-মিচির করছে। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা সকাল।
ফায়াজ এই মিষ্টি রোদে ঘাসের উপর বসে সাদা ধবধবে একটা খরগোশকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। ফায়াজের হুট করে শখ হলো একটা খরগোশ পুষবে। তাই অনেক সন্ধান করার পর মন মত একটা খরগোশ পেয়েও গেল। ফায়াজ কচি ঘাস খরগোসের মুখের সামনে রাখছে৷ সেগুলো কুটকুট করে খাচ্ছে। এ ক’দিনের ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
ফায়াজ গেট খোলার কেচ শব্দে সেদিকে তাকাল। মেহের ভেতরে ঢুকছে। ফায়াজ মুচকি হেসে আবার খরগোশের দিকে মনোযোগ দিল। ফায়াজ যেন জানত মেহের আসবে এমন ভাব করছে।
মেহের কাঁধের লেডিস্ ব্যাগটায় বাম হাত রেখে হাঁটছে। ডান হাতে মোবাইল ফোন। হটাৎ করে চোখ গেল ডান দিকের বাগানের অংশে। মেহের দাঁড়িয়ে গেল। দু’হাতে কপালের দিকটার হিজাব ঠিক করে ফায়াজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফায়াজকে কিউট একটা খরগোশকে খাওয়াতে দেখল। পাশেই মোবাইল ফোনটা রাখা। খরগোশটা মেহেরের বেশ লাগছে, মিষ্টি হাসল। নিমিষেই ফায়াজের প্রতি যে রাগ ছিল তার রেশ কেটে গেল।
ফায়াজ চোখ তুলে একবার মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর আবার কচি ঘাসগুলো খরগোশের মুখের সামনে দিচ্ছে৷
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
মেহেরের ইচ্ছে করছে খরগোশকে হাত দিয়ে ছুতে। মেহের হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কাঁধের ব্যাগটা পাশেই রেখে তার উপর হাতের মোবাইল ফোনটা রাখল। তারপর খরগোশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ধরতে পারল না। কারণ সেটি সরে গিয়ে ফায়াজের হাতের কাছে গেল। মেহেরের একটু মন খারাপ হলো। হাত সরিয়ে নিল।
নাক ফুলিয়ে বলল,
“তোর মালিক যেমন তোকেও ঠিক তেমন বানিয়েছে।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“কি বললে তুমি? যেমন মালিক মানে?”
মেহের ভ্রু প্রসারিত করে বলল,
“আপনি রাত থেকে কল পিক করছেন না কেন?”
“আমার ফোন, আমার ইচ্ছে। তুলতে ইচ্ছে হলে তুলব, না ইচ্ছে হলে তুলব না। কার কি?”
মেহের রেগে গিয়ে বলল,
“কেন তুলবেন না? আমি না তুললে তো মাথার চুল ছিড়ে ফেলেন। আর আপনি না তুললে সব মাফ।”
ফায়াজ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তোমাকে বলেছি মাফ করতে? নেও তুমিও আমার চুল ছিড়ে ফেল।”
মেহের ফায়াজের উত্তর শুনে দমে গেল। কি করে কোরিয়ান হিরোদের মত এত সুন্দর চুলগুলো ছিড়বে।
মেহের তাই চুপ করে বসে রইল। ফায়াজ ওঠে গিয়ে বেঞ্চের উপর রাখা গাজর নিয়ে খরগোশকে খেতে দিল।
মেহের উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওর জোড়া কই?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“ওর কোন জোড়া নেই। ও একা।”
“আমি তো শুনেছি একা খরগোশ বেশীদিন বাঁচে না। আপনি ওর জন্য সাথী নিয়ে আসুন।”
মেহের উত্তরের আশায় ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরের বরাবর দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“মরে যাক।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে অবাক হল। কি হার্টলেসের মত কথাবার্তা।
ফায়াজ আবারও খরগোশের পাশে বসে পড়ল। মেহের তখনও দাঁড়িয়ে আছে। মশাইয়ের যে প্রচুর রাগ হয়েছে বুঝতে পারছে।
মেহের ফায়াজের পেছনে বসে পেছনে থেকে দু’হাতে ফায়াজের গলা জড়িয়ে ধরল। ফায়াজের পিঠের উপর কপাল ঠেকিয়ে রাখল। ফায়াজ মেহেরের কাছ থেকে এমন কিছু আশা করে নি। তাই শকড হয়ে বসে রইল।
মেহের ফায়াজের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে বলল,
“এত রাগ করার কি হলো? আমি জাস্ট একটা প্রস্তাব রেখেছি। আপনার পছন্দ না হলে মানা করবেন৷ ঘটনা সেখানেই শেষ। গতকাল রাতে কতবার ফোন করলাম। আপনি এক বারের জন্য কল রিসিভ করলেন না। আবার আপনিই বলেন আমার সাথে না-কি একদিন কথা না বলে থাকতে পারেন না।”
ফায়াজ চুপ করে আছে। তারপর শুধু বলল,
“এই যে তুমি আমাকে এভাবে ধরে, আমার সাথে এভাবে লেপ্টে আছো, কেউ দেখলে? বাড়িতে তো মানুষের অভাব নেই। শেষে আমাকে বলবা লুচু।”
মেহেরের টনক নড়ল। সকাল বেলায় নিশ্চয়ই ফায়াজের বাবা বাড়িতে। যদি দেখেন তাহলে কি ভাববে? এছাড়া ওয়াচম্যান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মালি আর সার্ভেন্টও তো আছেই।
মেহের ছিটকে সরতে গেলে ফায়াজ নিজের গলায় রাখা মেহেরর দু’হাত চেপে ধরল। মেহের ছুটার জন্য ছটফট করছে কিন্তু ফায়াজ ছাড়ছে না।
মেহের বিরক্ত হয়ে বলল,
“কি আশ্চর্য! আপনি নিজে বলে নিজেই কি শুরু করেছেন। আমার হাত ছাড়ুন। কেউ দেখবে।”
ফায়াজ ছাড়ছে না। মিটমিট করে হাসছে। ফায়াজ মেহেরের দু’হাত আগলে রেখে মেহেরের দিকে ঘুরল। তাতে মেহেরের হাতের বাঁধন হালকা হয়ে গেলে মেহের ছিটকে পড়তে নেয়। কিন্তু ফায়াজ পড়তে না দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেহের ছুটার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিল। যদি ফায়াজের বাবা দেখে তাহলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। উনার সামনে যেতে পারবে না লজ্জায়।
মেহের আকুতির সুরে বলল,
“ফায়াজ, কি শুরু করেছেন? বাবা দেখলে কি হবে বুঝতে পারছেন? লজ্জায় মরে যাব।”
“এত কিসের লজ্জা৷ আমার বউকে আমি জড়িয়ে ধরেছি। আর তুমি তো পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরো নি।”
“আপনি এত নির্লজ্জ কেন? বাবাকেও লজ্জা পান না।”
ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“বাবা, অফিসে গিয়েছে। বাড়িতে নেই।”
“ওহ! তাহলে আপনার অফিস নেই? এখানে বসে আছেন কেন? রেডি হবেন না? ৯টার বেশি বাজে।”
ফায়াজ তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আমাকে অফিসে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। চলো আজ তুমি আমাকে রেডি করিয়ে দিবে। ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে৷ বেষ্ট উইশ জানাবে।”
ফায়াজ খরগোশটা হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। মেহেরও নিজের ব্যাগ আর মোবাইল ফোন তুলে ফায়াজের পেছনে পেছনে গেল।
মেহের আলমারি খুলে খোঁজে খোঁজে ফায়াজের জন্য পছন্দসই একটা স্যুট বের করছে। ফায়াজ তখনই মেহেরকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল।
“আরে স্যুট তো বের করতে দিন। আপনার না দেরি হয়ে যাচ্ছে?”
ফায়াজ মেহেরের কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
“কে বলল দেরি হয়ে যাচ্ছে?”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“আপনিই না একটু আগে বললেন?”
“ওটা তো তোমাকে ঘরে আনার জন্য বলেছি। আমার মিটিং দুপুর ১২টায়। মিটিংয়ের আগ পর্যন্ত রোমান্স চলবে।”
মেহের ফায়াজকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এতবড় মিথ্যা কথা? আপনি রোমান্স নিয়ে বসে থাকুন। আমার ক্লাস আছে।”
“একদিন ক্লাস না করলে কিছু হবে না। এত ক্লাস করে কি হবে? তার চেয়ে আমার দিকে নজর দেও।” মেহেরের দিকে আগাতে আগাতে।
মেহের ফায়াজকে ধাক্কা মেরে বলল,
“আপনি তো দেখছি আমার পড়াশোনা নষ্ট করার ধান্দা করছেন। আপনার থেকে সাবধানে থাকতে হবে।”
“আর সাবধানে থেকে কি করবে?”
ফায়াজ আচমকা মেহেরকে বিছানায় ফেলে দিল।
মেহের আকস্মিক থাক্কায় ব্যথা না পেলেও “ও মা গো” বলে ফায়াজের দিকে কটমট করে তাকাল।
ফায়াজ মুচকি হেসে মেহেরের পাশে শুয়ে পড়ল। মেহেরকে টেনে সোজা করে নিজের কাছে নিল।
মেহের ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার হাড়-গোড় ভেঙে ফেলেছেন। ও মা গো।”
“মিথ্যুক মেয়ে! নাচ-গানের সাথে এক্টিংও দেখছি ভালো জানো।”
মেহের ধরা খেয়ে চুপ করে গেল।
“আমার ক্লাস মিস হয়ে যাবে। সত্যি বলছি।”
“আমিও সত্যি বলছি ক্লাস মিস হয়ে যাক। যেতে হবে না।”
“বাড়িতে জানলে কি হবে বুঝতে পারছেন? ক্লাসের কথা বলে বের হয়েছি। সবাই জানে এখন আমি ভার্সিটিতে।”
“ওমন সবাই বলে। ক্লাসের কথা বলে বফের সাথে দেখা করতে যায়, ঘুরতে যায়, ফুচকা খেতে যায়৷ তুমি না হয় ক্লাসের কথা বলে স্বামীর সাথে দেখা করতে এসেছো।”
“আমাকে আপনার ওমন মেয়ে মনে হলো? আমি কখনো মিথ্যা বলে ক্লাস মিস করে কখনো কারো সাথে দেখা করতে যাই নি। আজ আমি ক্লাসের আগে এসেছি আপনার সাথে একটু কথা বলে ক্লাসে যাব তাই।”
“ঠিক আছে। আমি ১১টার দিকে বের হব৷ তোমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাব৷ বাকি ক্লাসগুলো করবে। এখন আমার সাথে থাকবে। ব্যাস।”
মেহের আর কিছু বলতে পারল না। বাধ্য হয়ে থেকে গেল। মেহেরের যে ফায়াজের সাথে থাকতে ইচ্ছে করছে না তা নয়।
ফায়াজ মেহেরের হাত নিয়ে ওর আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গুজল। তারপর হাত উঁচু করে হাতে চুমু খেয়ে বলল,
“আর মাত্র ১৭দিন। উফফ! মাত্র না। ১৭দিন যেন ১৭যুগ। বিবাহিত হয়ে ব্যাচেলর জীবনযাপন করছি। বউ থেকেও বউ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? সব তোমার ওই হিটলার বাপের জন্য।”
মেহের ভ্রু কুচকে তাকাল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ সেটা দেখে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। যা সত্যি তাই বলেছি। তুমিও জানো আমি সত্যি বলেছি। তোমার বাপ আমার জীবন্টা ত্যানা ত্যানা করে দিল। হিটলার একটা শ্বশুর পেয়েছি।”
“এভাবে বলবেন না। আমার বাবা হিটলার না। একটু কড়া হতে পারে কিন্তু হিটলার না।”
“হইছে, আর সাফাই গাইতে হবে না। ক’দিনের ব্যাপারই তো সহ্য করে নেব৷ তারপর এক মুহুর্তের জন্য বউকে একা ছাড়ব না। তোমার সাথেই যাব ও বাড়ি আর তোমার সাথে ফিরব। ঘর জামাই মনে করেছিলেন উনি আমাকে। তাই তাড়িয়ে দিলেন।”
মেহের চোখ বড়বড় করে বলল,
“আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছে?”
ফায়াজ মিনমিন করে বলল,
“ওই একি হল। তাড়িয়ে দেওয়া নয় তো কি।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে গাল ফুলিয়ে রাখল। ফায়াজ মেহেরের আরো কাছে গেল। ফায়াজের উষ্ণ নিশ্বাস আঁচ করতে পেরে মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ মেহেরের নাকে নাক ঘষে চুমু খেল। মেহের চোখ বন্ধ করে নিল। কেমন অদ্ভুৎ অনুভূতি হচ্ছে। চোখ খোলার পর পরিবেশ স্বাভাবিক লাগছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে।
মেহের পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
“খরগোশটা একা। ওর জন্য আরেকটা সঙ্গী খরগোশ আনবেন।”
ফায়াজ মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা, তুমি যৌতুক হিসেবে একটা মেয়ে খরগোশ নিয়ে এসো। ওদের জোড়া হয়ে যাবে। তুমি আমি, খরগোশ-খরগোশনী।”
ফায়াজ-মেহেরের বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। মেহের বিয়ের শপিং নিয়ে ব্যস্ত। সব কিছু ফায়াজের সাথে ফায়াজের পছন্দ মতো নিচ্ছে। ওর সবকিছু ফায়াজের পছন্দ মতো চাই।
আজকে মেহেরের গায়ে হলুদ। মাহি হলুদের জিনিসপত্র নিজ হাতে স্টেজের সামনে নিয়ে যাচ্ছে। তূর্জ মিশানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব তদারকি করছে৷ মেহেরের সাজ কমপ্লিট। মেহেরের মা মেহেরকে দেখতে এসেছেন।
কাচি হলুদ রঙের শাড়ি আর ফুলের গহনাতে মেহেরের রুপ যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেরের মা অপলক মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহেরের মাথায় হাত রেখে বলল,
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪৫
“মাশাল্লাহ! আমার মেয়েকে খুব সুন্দর লাগছে৷ আমি চেয়েছিলাম ধুমধামে তোর বিয়ে দেব। তোকে এই সাজে দেখব। আমার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যেন তোকে সুখী করে।”
মেহেরের মা ঘুরে গিয়ে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছেন।
চলবে…..!
(প্রথমেই দুঃখীত গত পর্বের শেষের এলোমেলো অংশটুকুর জন্য। কোন এক কারণে বারবার চেষ্টা করার পরেও কপি পেষ্ট হচ্ছিল না। পরে কিভাবে কি হয়েছে বুঝতে পারি নি। সরি। সবাইকে মেহের আর ফায়াজের বিয়ের দাওয়াত রইল।)