শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪৮
ফাবিহা নওশীন
পবিত্র কালেমাকে সাক্ষী করে কবুল পড়ে দুজন আবারও নতুন করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। সবাই ওদের দাম্পত্য জীবনের জন্য দোয়া করছে। ফায়াজ বারবার আড়চোখে মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। দোয়া শেষে ফায়াজ মেহেরের সাথে কথা বলার সুযোগ পেল।
মেহের এতক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে থাকলেও এখন আর সে ভয়টা কাজ করছে না।
“মেহের, তোমার ফোন কোথায়? তোমাকে কতবার ফোন করেছি রিসিভ করো নি কেন?”
মেহেরের কাছে ফায়াজের কন্ঠ আর বিহেভিয়ার স্বাভাবিক লাগছে। হয়তো ফায়াজ জানে না ওর মা এসেছে। কি করেই বা জানবে ও তো এসেই নতুন বরের মতো বসে আছে। মেহের শুধু শুধু ভয় পেয়েছে। কিন্তু ফোন রিসিভ না করার জন্য কি কারণ দেখাবে। এ নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কিছু একটা বানিয়ে বলে দিতে হবে।
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে তখন ফোন কাছে ছিল না। কত মানুষ ছিল। বুঝতেই পারছেন তাই রিসিভ করতে পারি নি। কোন প্রয়োজন ছিল?”
ফায়াজ মৃদু হেসে বলল,
“তোমার সাথে তো আমার সবসময়ই প্রয়োজন থাকে, বউ।”
মেহের মনে মনে হাফ ছেড়ে বাচল। এর মানে ফায়াজ অন্য কারণে ফোন করেছে৷
বিয়ে পড়ানো শেষ। তাই ফায়াজের মা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি ফাইজাকে একটা মেসেজ করে গেইট দিয়ে বাইরে বের হলো। দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে ফোন করছে।
“কেমন আছো ফাহমিদা?”
গম্ভীর আর পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনে পিলে চমকে উঠল। হটাৎ করেই দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন অনবরত আঘাত করছে। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো শব্দ বারবার ভেসে আসছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। সাথে বাড়ছে অস্বস্তি।
ফায়াজের বাবা কোন উত্তর না পেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আমিও না কি জিজ্ঞেস করছি। নিশ্চয়ই ভালো আছো। তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তুমি খুব ভালো আছো।”
ফায়াজের মায়ের অস্বস্তি যেন তরতর করে বেড়ে গেল। অস্বস্তি নিয়েই বলল,
“অবশ্যই খুব ভালো আছি। না হলে চোরের মতো লুকিয়ে ছেলের বিয়ে দেখতে আসি? ছেলে বিয়ে করছে আর ছেলের বাবা ছেলের মা’কেও বলার
প্রয়োজন মনে করছে না। হ্যা ভালো তো আছিই।”
“ফায়াজ, তোমাকে এলাও করবে না তাই জানাই নি। আর কি জানাব? কেন জানাব? তোমার ছেলের প্রয়োজন আছে? ছেলের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করেছো?”
ফায়াজের মায়ের তীক্ষ্ণ জবাব,
“এর জন্য নিশ্চয়ই আমি দায়ী নই। আর কে দায়ী সেটা নিশ্চয়ই জানো।”
ফায়াজের বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এখনো দাম্ভিকতা বজায় চলছো। নিজের ভুল, অন্যায় কখনও স্বীকার করবে না। দোষ কি একার আমার?”
ফায়াজের মা চুপ করে আছে। এক হাতে তালি বাজে না। হয়তো দোষ দু-জনেরই ছিল। কেউ নিজের দোষটা মেনে নেয় নি।
ফায়াজের মা ওনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“হয়তো একার ছিল না কিন্তু দোষ নামক বস্তুটার ১০আনার মালিক তুমি ছিলে। সেদিন তুমি যদি নিজের ইগো বজায় না রেখে আমাকে ফিরিয়ে আনতে যেতে তাহলে আজ দৃশ্যটা অন্যরকম থাকতো। যাক গে সে-সব কথা। ভালো থেকো।”
ফায়াজের মা চলে যেতে নিলে বাঁধা দিয়ে বলল,
“অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো? তুমি চাইলে নিজের সংসার, সন্তানের জন্য ইগো বিসর্জন দিয়ে আসতে পারতে না? কিন্তু তা করো নি। সেটা যখন করোনি তাই আমাকে দোষারোপ করার কোন রাইট তোমার নেই। ফাইজাকে নিয়ে চলে গেলে দূর দেশে।”
“আমি যদি ফাইজাকে নিয়ে না যেতাম তাহলে তুমি কি করতে নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি। ফাইজাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে। আমাকে নিঃস্ব করে দিতে। তুমি সব সময় নিজেরটা বুঝো। নিজের বুঝের জন্য অন্যকে কষ্ট দিতে তোমার বিন্দুমাত্র বিবেকে বাঁধে না। জানি না এতদিন ফায়াজকে কি বুঝিয়েছো। ছেলেটা আমাকে দু-চোখে দেখতে পারে না।”
(চোখের পানি ফেলে)
ফায়াজের বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
“হু, ও বোধহয় আমাকে খুব ভালোবাসে? ও আমাকে ঘৃণা না করলেও ভালোবাসে না। ওর জীবনে আমার বিশেষ স্থান নেই।”
ফায়াজের মা বিস্ময় নিয়ে তাকাল।
ফায়াজের বাবা আলতো হেসে বলল,
“এটাই সত্য। ওর সাথে আমার কোন কালেই সু-সম্পর্ক ছিল না। আমি তৈরি করতে পারি নি। ও নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে। ওর যা প্রয়োজন ও নিজেই আদায় করে নিতে পারে। কারো প্রয়োজন পড়ে না। শুধুমাত্র ফর্মালিটির জন্য আমি আছি। যেমন আজকের বিয়ে।”
ফায়াজের মা চুপ করে আছে। নিজেদের জন্য দুটো বাচ্চাই ছন্নছাড়া জীবন যাপন করছে। পরিবার, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত।
মেহেরের বিদায় বেলায় মেহের মা’কে জড়িয়ে কাঁদছে। এতদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে অভস্ত্য হয়ে পড়েছিল। মনেই হয়নি দীর্ঘ সময় তাদের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। ফায়াজের বাড়িতে থেকেছে, হোস্টেলে থেকেছে কিন্তু এতদিন বাড়িতে থাকায় মনেই হয় নি এ বাড়ির বাইরেও ছিল। রোজ রাতে মা ওর রুমে গিয়ে ঘুরে আসত। ইচ্ছে হলে মায়ের কোলে ঘুমাত।
মায়ের হাতে ভাত খাওয়াটা ভুলবে কি করে। বাবার সাথে ভাঙাচোরা সম্পর্কটাও জোরালো হয়েছিল। এ বাড়ি পদতলে মুখরিত করেছিল। নিজের ঘরটাকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছিল। সেটাকেও মিস করছে। বুকের ভেতর ভাংচুর হচ্ছে। নতুন করে ছিন্ন হওয়ার ব্যথা।
মেহের মা’কে জড়িয়ে কাঁদছে আর বলছে,
“তোমাকে খুব মনে পড়বে। আমি তোমার আদর, ভালোবাসা খুব মিস করব।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে অন্যদিকে ঘুরে গেল। ওর ভেতরটা কেমন করছে। যতই মুখে মা’কে আসতে মানা করুক আজ জীবনের এমন একটা দিনে মা’কে কাছে না পেয়ে ব্যথাতুর অনুভূতি হচ্ছে।
মেহেরের মা-ও কেঁদে ভাসাচ্ছে। এতদিনের শূন্য ঘর মেহের পূর্ন করে রেখেছিল এখন আবার শূন্য করে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
মেহের পুরো রাস্তা ফুপাতে ফুপাতে এসেছে।
এখন ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার মাঝে বসে আছে। বসে বসেও কিছুক্ষণ ফুপিয়েছে। এখন একটু স্বাভাবিক লাগছে। পা ঝিম ধরে গেছে। আর কেঁদে-কেটে মেকাপেরও বারোটা বাজিয়েছে। ফ্রেশ হওয়া দরকার। মেহের বিছানার মাঝে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে বিছানায় আঘাত করছে। তাতে গোলাপের পাপড়িগুলো ছিটিয়ে পড়ছে। ঝিম ধরা পা বিরক্ত লাগছে। কিন্তু এতেও কমছে না। মেহের বিছানা থেকে নেমে পা দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তাই মেঝেতে বসে পড়ল। পায়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে টুকা দিচ্ছে বারবার।
দরজা খোলার শব্দে মেহের সেদিকে তাকাল। ফায়াজ এসেছে। ফায়াজ মেহেরকে মেঝেতে পা ধরে বসে থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে দৌড়ে এসে ওর পাশে বসে মেহেরের পায়ে হাত দিতেই মেহের চেঁচিয়ে উঠে।
ফায়াজ দ্রুত হাত সরিয়ে বলল,
“কি হয়েছে পায়ে? বিছানা থেকে পড়ে গেছো নিশ্চয়ই। ভেঙে গেল না তো? হসপিটালে নিতে হবে।”
মেহের ফায়াজের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে হতবাক। ওর এমন চোখ বড়বড় করা রিয়েকশনের আগামাথা বুঝতে পারছে না।
মেহের পায়ে আবারও টুকা মেরে বলল,
“আমার পা ভাঙে নি। ঝিম ধরেছে।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল। মেহের অনুভব করছে ওর পা এখন আগের মতো ঝিম ধরা নেই।
ফায়াজ রাগান্বিত হয়ে বলল,
“কিন্তু ভাব তো এমন করলে যে পা ভেঙে গেছে। সামান্য ঝিম ধরা নিয়ে এত নাটক করে কেউ? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে একটা মেজর প্রব্লেম থেকে সেড়ে উঠলে এখন আবার…”
মেহের উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এত জ্ঞান না দিয়ে হাত ধরে তো দাঁড় করাতে পারতেন। মেকাপ নষ্ট হয়ে পেত্নীর মতো বসে আছি।”
ফায়াজ ওঠে দাঁড়িয়ে মেহেরকে ভালো করে দেখল। আসলেই চোখের নিচের বড় একটা অংশ মেকাপ নষ্ট হয়ে গেছে। কান্নাকাটির ফলে এই অংশটুকু খাওয়া খাওয়া লাগছে।
ফায়াজ নষ্ট মেকাপের স্থানে আঙুল দিয়ে বলল,
“বউ সাজে দেখতেও পারলাম না। মেকাপ সব নষ্ট করে ফেলেছো। আজ না কাঁদলে কি হতো?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে অবাক।
“আজ আমার বিয়ে আজ কাঁদব না তো পরশু কাঁদব? অদ্ভুত সব কথা বলেন আপনি। আর না কেঁদে মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে আসলে মানুষ কি বলবে?”
ফায়াজ আগ্রহ নিয়ে বলল,
“কি বলবে?”
মেহের ফায়াজের দিকে সরু চোখে তাকাল তারপর বলল,
“বলবে মেয়ে বিয়ের জন্য পাগল। শ্বশুর বাড়ি যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“তা নয় কি? তুমি পাগল ছিলে না? বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য কম প্যারা দিয়েছো?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিল লজ্জায়। ফায়াজ মেহেরের গালের সাথে নিজের গাল মিলালে মেহের ছিটকে সরে গিয়ে বলল,
“ফ্রেশ হবো।”
ফায়াজ মেহেরের অবস্থা বুঝে মনে মনে হাসছে। তারপর বলল,
“হ্যাঁ অবশ্যই। যাও যাও। ফ্রেশ হয়ে এসো।”
মেহের দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে নিজের সব গয়না খুলে ফেলল। গয়নার স্তুপের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“এক গাট্টি গয়না। এত ভার আমি বইলাম কি করে? এগুলোর ওজন বইতে বইতে আমার ওজন এক দিনেই পাঁচ কেজি কমে গেছে।”
মেহের ফ্রেশ হতে যাবার পর ফায়াজ ফুলে ফুলে সাজানো বিছানাটা দেখছে। কতগুলো গোলাপের পাপড়ি হাতে নিয়ে ফু মারল। হটাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠল। ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে স্কিনে আননোন নাম্বার দেখতে পেল। অপরিচিত কেউ এত রাতে ফোন। ফায়াজ ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। নেটওয়ার্ক প্রব্লেম মনে করে ফায়াজ জানালার পাশে গেল। কিন্তু তাও কেউ কথা বলছে না। ফায়াজ নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট অনুভব করছে। কল কেটে গেল। ফায়াজ তখন হ্যালো হ্যালো বলে বিরক্তি নিয়ে হাতের ফোনের দিকে তাকাল।
মেহের বের হয়ে ফায়াজকে দেখে বলল,
“কে ফোন করেছে?”
মেহের মেরুন রঙের একটা শাড়ি পরে বের হয়েছে।
ফায়াজ মেহেরকে ভালো করে দেখে বলল,
“জানি না। অপরিচিত নাম্বার।”
তারপর আবার ফোন বেজে উঠল৷ তখনও কেউ কথা বলছে না। কয়েকবার হ্যালো বলে ফায়াজ ফোন কেটে দিল। মেহের চিন্তিত মুখে ফায়াজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রয়োজনীয় কল নয়তো? কে হতে পারে?”
“মেহের, প্রয়োজনীয় কল না। কেউ ইচ্ছে করে কথা বলছে না। প্রয়োজনীয় হলে কথা বলত। আমার মনে আমার বন্ধুরা মজা করছে। আমাদের বাসর ঘরে ডিস্টার্ব করতে চায়। ওকে ফাইন।”
ফায়াজ ফোন অফ করে দিল। তারপর বলল,
“প্রায় দু’বছরের বিয়ের প্রথম বাসর। আর ফোন কল ডিস্টার্ব করবে অসম্ভব।”
ফায়াজ ফোন রেখে মেহেরের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি কি বলো?”
মেহেরের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমতা আমতা করে দৃষ্টি নত করে বলল,
“আমি কি বলব?”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪৭
ফায়াজ মেহেরের নত চোখের পাপড়িতে চুমু খেয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কোলে তুলে নিল। মেহের চোখ বন্ধ করে ফায়াজের হাত শক্ত করে ধরে আছে। ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ওর কপালে চুমু খেল। দুটো ভালোবাসার মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে পূর্ণতার দিকে।
গভীর রাত। পাখির কিচিরমিচির শব্দ জানান দিচ্ছে সকাল হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আজান পড়বে। ফায়াজের লোমশ বুকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তার মেহেরজান। ফায়াজ মেহেরের মুখের উপরে থাকা এলোমেলো চুল কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে।