শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫১
ফাবিহা নওশীন
রাত বাড়ছে। ফায়াজ বিছানায় শুয়ে গভীর ভাবে কিছু ভাবছে। চোখ বন্ধ। কপালে হাত দিয়ে চোখ পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। মেহের ফায়াজকে খাওয়ার কথা বললে ফায়াজের ক্ষিধে নেই জানিয়েছে। মেহের ফায়াজের কথা শুনে দরজা বন্ধ করে দিল। ফায়াজ মেহেরের দরজা বন্ধ করার শব্দে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মেহের জানতো ফায়াজ খাবে না। তবুও জিজ্ঞেস করেছে। ওর নিজেরও খাওয়ার ইচ্ছে নেই। বিকেল বেলায় যে ঘটনা ঘটেছে তাতে খাবার মুখে রুচবে না। মেহের সার্ভেন্টকে বলে এসেছে সময় মতো ফায়াজের বাবাকে খাবার দিয়ে দিতে।
মেহের ফায়াজের পাশে গিয়ে বসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
“ফাইজার কথায় কষ্ট পেয়েছো?”
ফায়াজ শুধু জোরে শ্বাস ফেলল কোন জবাব দিল না। মেহের ফায়াজের কাছ থেকে জবাবের আশা ছেড়ে দিল।
ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ওর আর ওর ভাইকে দরকার নেই।”
ফায়াজের আহত সুরে বলা কথাটা মেহেরের বুকে গিয়ে লাগল।
“ফায়াজ, তুমি ওর কথাটা ধরলে কিন্তু কোন সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেছে সেটা দেখলে না? ফাইজা তোমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটাও তো কষ্ট পেয়েছে আজ। ওর স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। তাই নিজেকে সামলাতে পারে নি। তাই ইমোশনাল হয়ে বলে ফেলেছে। ওর কথায় মন খারাপ করো না।”
ফায়াজ মেহেরের কোলে মাথা রাখল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি আজ ওকে খুব কষ্ট দিয়েছি। হয়তো আজ আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
“ফায়াজ, এভাবে বলো না। রক্তের সম্পর্ক কখনও শেষ হয় না। তোমাকে একটা কথা বলি ঠান্ডা মাথায় শোন। এটা ফাইজারও বাড়ি। ওর এখানে পূর্ণ অধিকার আছে। তোমার মায়েরও বাড়ি এটা। এই বাড়ির প্রকৃত মালিক তোমার বাবা। আর তোমার বাবার সাথে বৈবাহিক সূত্রে তোমার মা এ বাড়িতে এসেছে। এটা তারও বাড়ি। এখানে সে তার সংসার সাজিয়েছে। কতগুলো বছর থেকেছে। তার অধিকার আছে এ বাড়িতে। তুমি আর ফাইজা তাদের সন্তান। উত্তরাধিকারী সূত্রে তোমরা এ বাড়িতে থাকার অধিকার পেয়েছো। সেক্ষেত্রে তুমি আর ফাইজা উভয়েই সম-অধিকারী। এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশী কারো অধিকার থাকে সেটা তোমার বাবা-মায়ের। তোমার মা এ বাড়িতে আসতে চাইলে তুমি কিংবা আমি তাকে বাঁধা দিতে পারি না। এমনকি তোমার বাবাও না। তোমার মা-বাবা একে অপরকে ভালোবাসে। তারা এতটা দিন দূরে থেকেছে কিন্তু একে অপরকে এখনো ভালোবাসে। তারা আবারও এক সাথে থাকতে চায়। বয়স হয়েছে তাদের। আর কতকাল একা থাকবে? সন্তান হিসেবে তোমার কি উচিত হবে তাদের এক সাথে থাকার পথে বাঁধা হওয়ার? আর ফাইজা ওর কথা ভাবো। বাচ্চা বয়স থেকে মা’য়ের সাথে থাকছে। বাবাকে পায় নি। ওর তো বাবাকে প্রয়োজন। ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। ক’দিন পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। মেয়েটা চাইছে ওর পরিবারের সাথে থাকতে। ভাই হিসেবে তোমার কি উচিত না ওর ইচ্ছেগুলো পূরণ করার?”
ফায়াজ কিছু ভাবছে। তারপর বলল,
“ঠিক আছে। ওরা আসুক এ বাড়িতে। তোমাকে নিয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাব।”
প্রথম কথাগুলো শুনে মেহের খুশি হলেও শেষের লাইন শুনে মুখ শুকিয়ে গেল।
ফায়াজ এমন কিছু বলবে ভাবতেও পারে নি।
“ফায়াজ আমরা কোথায় যাব? এটা তোমারও বাড়ি। এখানে তুমি ছোট থেকে বড় হয়েছো। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমরা চলে গেলে বাবা কত কষ্ট পাবে ভেবেছো? আর ফাইজা? ও তো শুধু বাবাকেই চায়নি, আমাদেরকেউ চায়। এসব ভাবনা একদম মাথায় এনো না। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। আমি একা একা কোথায় গিয়ে থাকব?”
ফায়াজ উঠে বসে। বিমর্ষচিত্তে বলল,
“আমি অনেক চেষ্টা করেছি সব মেনে নিতে কিন্তু পারছি না। আমি কি করে ভুলে যাব সেদিন আমাকে রেখে চলে গিয়েছিল। তারপর ১৬টা বছর কেটে গেছে।”
ফায়াজ কষ্ট পাচ্ছে তবুও মেহের জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছিল সেদিন?”
ফায়াজ তিন আংগুল দিয়ে কপাল ঘষে বলল,
“আমি আর ফাইজা স্কুল থেকে সবে বাড়িতে ঢুকেছি। উপরে থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবা-মা উচ্চস্বরে ঝগড়া করছিলেন। কাজের লোকেরা সব সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিল আর কানাঘুষা করছিল। আমাদের দেখে একে একে সবাই চলে গেল। আমি আর ফাইজা কিছুক্ষণ পর উপরে গেলাম। মা লাগেজ গোছাচ্ছেন। আমাদের দেখে বলল,
,” আজ আমরা বড় মামার বাসায় যাচ্ছি। তখন শুধু ছোট মামা ইতালি থাকতেন। বড় মামা দেশেই ছিলেন। আমাদের গায়ে তখনও স্কুল ড্রেস। কাঁধে ব্যাগ। মা এক হাতে লাগেজ আর আরেক হাতে ফাইজাকে ধরে বলল,
“চলো।”
কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ফাইজা ৫ বছরের আর আমি ৯ বছরের। মায়ের সাথে যাচ্ছিলাম৷ বাবা কোথায় থেকে এসে মায়ের কাছ থেকে ছু মেরে ফাইজাকে ছাড়িয়ে নিজের হাতে ফাইজার হাত আবদ্ধ করে নিল। আর অপর হাতে আমার হাত।
তারপর চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি আমার ছেলে-মেয়েদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? যাওয়ার হয় একা যাও।”
মা আবারও ফাইজাকে নিজের কাছে নিতে চাইলে বাবা সরিয়ে ফেলেন। ফাইজা ছোট মানুষ। এসব দেখে,আতংকিত হয়ে পড়ে কেঁদে ফেলে। সবার দৃষ্টি ফাইজার দিকে।
ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি মামা বাসায় যাব।”
ও তখনও ঝগড়া ব্যাপারটা বুঝে নি। ও মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করছে।
আমার কিছুটা হলেও বুঝ হয়েছে। ফাইজা কাঁদায় বাবা ওর হাত ছেড়ে দেয়। মা ফাইজার হাত ধরে আমার দিকে তাকাল। বাবা আমার হাত ধরে ফেলল। তারপর বলল,
“ফাইজা বাচ্চা মানুষ তাই যেতে দিলাম। কিন্তু ফায়াজ তোমার সাথে যাবে না।”
আমি তো আর ফাইজার মতো কাঁদতে পারি না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। মায়ের দিকে করুন ভাবে চেয়ে ছিলাম। মা আর বাবার সাথে তর্ক করল না। চলে গেল।
সেদিন আমি সারাদিন কেঁদেছি। স্কুল ড্রেসও চেঞ্জ করি নি, খাই নি পর্যন্ত। কয়েকদিন কেটে যাবার পরেও মা আসে নি। ফাইজাকে খুব মনে পড়ত। ফাইজা আমার ভীষণ বাদুক ছিল। সারাক্ষণ আমার পেছনে পেছনে ঘুরত। ওকে মারলেও কারো কাছে বিচার দিতো না। কখনই চাইতো না কেউ আমাকে বকুনি দিক।
বাবা মা’কে ফিরিয়ে আনে নি আর মা-ও ফিরেনি। একটু বড় হওয়ার পর মা আমাকে ফোন করে বলত তার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি যাই নি। এতদিন একা থেকেছি একাই থাকতে পারব। একাই থেকেছি। বাবাকে তো দেখোই সে বাড়ি তো দূর এই দেশেই থাকে না তেমন। সেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই করেছি। কেউ যেমন আদর করার জন্য ছিল না তেমনি শাসন করারও কেউ ছিল না। কেউ ছিল না বলার মতো এটা করো না, এটা খারাপ কাজ। এটা বলো না, এটা খারাপ কথা। কেউ বলে নি এটা করো, এটা ভালো কাজ। কেউ বলে নি কারো সাথে কেমন আচরণ করতে হবে। ভালো-মন্দের তফাত বুঝি নি। বুঝানোর কেউ ছিল না। যেটা ভালো মনে হয়েছে করেছি। সারাদিন বাড়িতে একা থাকতাম। সবাই বলতো আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কষ্ট পেতাম। যেটুকু সময় স্কুলে থেকেছি বন্ধুদের সাথে উল্টা-পাল্টা কাজ করেছি। সবাইকে প্রচন্ড জ্বালিয়েছি। এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ফায়াজ তৈরি হয়েছি। কি করতাম আমি? আমি কতটা কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছি আমি জানি মেহের। আমি সে দিন গুলো ভুলতে পারি না। হাজার চেষ্টা করেও পারি না। আমার প্রাচুর্য ছিল কিন্তু ভালোবাসা ছিল না। একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করেছি। কত কেঁদেছি। উনি পারতো না তখন ফিরতে?”
(ফায়াজ কাঁদছে।)
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫০
মেহেরের বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। এই মুহুর্তে ফায়াজের চাওয়ার চেয়ে বড় চাওয়া ওর কাছে আর কিছুই নেই। ফায়াজের কষ্ট সহ্য করতে পারছে না।
“ফায়াজ ঠিক আছে কান্না থামাও। প্লিজ কেঁদো না। তোমার যেটা ইচ্ছে করছে না সেটা তোমাকে করতে হবে না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। কেঁদো না।”
মেহের ফায়াজকে জড়িয়ে ধরল। এমন শক্ত মনের মানুষ এভাবে কাঁদছে সেটা সহ্য করতে পারছে না। ফায়াজও মেহেরকে দু’হাতে আগলে নিল।
Khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub sundor hoeache khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub valo legeche next part er janna opekkhay thaklam