শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫২
ফাবিহা নওশীন
ঘড়িতে বেলা সাড়ে আটটা বাজছে। তবুও ফায়াজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহেরের ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। তবুও শুয়ে আছে। উঠার তাড়া নেই। চুপিচুপি ফায়াজের চুল,গাল, চোখ, নাক ছুয়ে দিচ্ছে। ফায়াজ সারারাত অস্থির অস্থির করেছে। ঘুমাতে পারে নি। এই সকালের দিকে ঘুমিয়েছে৷ ফায়াজ গতকাল রাতে একদম বাচ্চাদের মতো আচরণ করেছে। মেহেরের মনে হচ্ছে প্রতিটি মানুষের ভেতরে একজন বাচ্চা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। প্রয়োজনে প্রবলভাবে জেগে উঠে৷
মেহের ফায়াজের বুকে হাত রাখতেই ফায়াজ ঘুমের মধ্যেই মেহেরের হাতটা জড়িয়ে নিল।
মেহের ফায়াজের আরেকটু কাছে গেল। ফায়াজের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফায়াজ একটু নড়ে-চড়ে উঠে। মেহের স্ট্যাচু হয়ে থাকে যেন ফায়াজের ঘুম না ভাঙে। ফায়াজ কিছুক্ষণ পরে আধো আধো করে চোখ মেলে। ঘুম ঘুম চোখে মেহেরের দিকে তাকাল৷
মেহের জিভে কামড় দিল।
“আহারে! কি সুন্দর ঘুমাচ্ছিলে। জাগিয়ে দিলাম।”
ফায়াজ স্নিগ্ধ হেসে মেহেরকে বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“অফিসে যেতে হবে।”
“একদিন অফিসে না গেলে কিছু হবে না। রাতে ঠিকমতো ঘুমাও নি। এখন একটু ঘুমাও।”
“তাহ হয় না কি? ঠিকঠাক যদি কাজ না করি তাহলে হবে? এমনিতেই আমি অকর্মা, কুলাঙ্গার ছেলে। নিষ্ঠুর, স্বার্থপর ভাই।”
“ফায়াজ, আবার ও-সব কেন বলছো? তুমি সবদিক থেকে পার্ফেক্ট।”
ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আচ্ছা মেহের একটা সত্য কথা বলবে?”
মেহের ফায়াজের বুকেই মুখ গুজে বলল,
“হু।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
“তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভুল? আমি অন্যায় করছি?”
মেহের একটু সরে ফায়াজের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আসলে অন্যায় কার সেটা আমি বুঝতে পারছি না,হয়তো বুঝার চেষ্টা করছি না। তুমি তো জানো আমি কতটা সফট মাইন্ডের। আমি মা, বাবা,ফাইজা,তুমি সবার কষ্ট দেখে সবার প্রতিই গলে যাচ্ছি। সবার কথায় কষ্ট মেশানো থাকে, তাই আবেগপ্রবণ না হয়ে পারি না। তাই এর সঠিক উত্তর আমি জানি না।”
ফায়াজও ভাবছে কা’কে কি জিজ্ঞেস করছে। যে সবার কথা ভাবে। সবার জন্য কাঁদে। কাদার মতো নরম মন যার তাকে জিজ্ঞেস করছে৷
মেহের ফায়াজকে বলল,
“শুনেছিলাম যেদিন মা চলে যায় তার কিছুদিন পরে তোমার বড় মামা তোমার বাবাকে ফোন করে বলে মা’কে গিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু বাবা তখনও মা’য়ের উপর রেগে ছিল তাই বলেছিল ওর আসার হলে নিজে আসবে, না ইচ্ছে হলে আসবে না। আমি আনতে কেন যাব? আমি দিয়ে এসেছিলাম? আমি আনতে যেতে পারব না। তারপর বড় মামার সাথে বাবার কথা কাটাকাটি চরম পর্যায়ে চলে যায়। তারপর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। মা সবটা মামার পাশে বসেই শুনছিল। বাবার এমন ব্যবহার মেনে নিতে পারে নি। যে সম্পর্কটা জোরা লাগাতে চেয়েয়েছিল তাতে নতুন করে ভাঙণ ধরে। কিছুদিন পর মা বাবাকে আবারও ফোন করে তবে ফেরার জন্য নয়। তোমাকে নিয়ে যাবে সেটা বলার জন্য। কিন্তু বাবা উলটো হুমকি দিয়ে বসে তোমাকে কিছুতেই দেবে না বরং আর কিছুদিন গেলে ফাইজা আরেকটু বড় হলে ওকে নিয়ে আসবে। তাদের সমস্যা কিছুতেই মিটছিল না। দিন দিন বাড়ছিল। নিজের ভাঙা সংসার এ-সব নিয়ে মা ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে। তোমার বড় মামাও ইতালি চলে যাবে তারপর একা একা কি করবে দেশে। তোমার বাবা ফাইজাকে নিয়ে যাবে সে ভয়ও ছিল। কারণ বাবা তোমার মামাদের চেয়েও বেশী প্রভাবশালী। আর মামাদেরও তো নিজের লাইফ আছে। কতদিন আর তোমার মায়ের জন্য ঝামেলা পোহাবে। তখন তুমি আরেকটু বড় হয়েছো। তোমার মনের ভেতর রাগ পুষিয়ে রাখতে রাখতে সেটা বড় আকার ধারণ করেছিল। মা তোমার স্কুলে তোমার সাথে দেখা করতে গেলে তুমি রাগারাগি করে চলে এসেছিলে। তুমি মা’য়ের কাছে যাবে না সাফ জানিয়েছিলে। তারপর মা ফাইজাকে নিজের কাছে রাখতে কাউকে কিছু না জানিয়েই ফাইজাকে নিয়ে ইতালি চলে যান। তোমাকে রেখে চলে যা। উনি হয়তো আরেকটু চেষ্টা করলে তোমাকে মানাতে পারতো, বুঝাতে পারতো কিন্তু তিনি তা করেন নি। তোমাকে রেখে না গেলেও পারতেন। এখানে তার দোষ রয়েছে। তবে বাবাও কিন্তু দোষী। তার এতটা রাগ, জেদ দেখানো উচিত হয় নি। পারতেন মা’কে ফিরিয়ে আনতে।”
“হ্যাঁ মেহের বাবাও দোষী আর এটা আমি ছোট থেকেই মানি। তাদের দুজনের জন্যই আমি অনাথের মতো বড় হয়েছি। আমার হাসিখুশি একটা পরিবার ছিল। আদর, স্নেহ, ভালোবাসা ছিল। সারাদিনের খেলার সঙ্গী ফাইজা ছিল। কত সুন্দর ছিল সে-সব দিন। কিন্তু হুট করেই জীবনটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। আমার ইচ্ছে করতো এসব ছেড়ে কোথাও চলে যাই। কিন্তু কোথায় যেতাম আমি মেহের? ছোট ছিলাম। জীবন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি। তাই পারি নি সব ফেলে চলে যেতে। বড় হওয়ার পর অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এসবে। তবে বাবাকে ভালোবাসতে পারি নি। তাকে সর্বদা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। আর এড়াবোই বা কি? তিনি তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমি যে তার ছেলে বেঁচে আছি না মরে গেছি এসব তার মনে কখনো পড়েছে কি-না সন্দেহ। দেখেছো তো আমি বাবার সাথে কেমন ব্যবহার করতাম?”
“হুম দেখেছি। ফায়াজ আমি বাবা, ফাইজা, তুমি, মা সবার ব্যথায় ব্যথিত হই। তবে…..”
ফায়াজ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তবে কি?”
মেহের ফায়াজের চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার ব্যথায় আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মনে হয় আমি তুচ্ছ একদমই তুচ্ছ। তুমি কষ্ট পাচ্ছো আমি কিছুই করতে পারছি না। ফায়াজ যে তোমাকে কষ্ট দিবে, যেটা তোমাকে কষ্ট সে কিংবা সেটা আমার অতি পছন্দনীয় নয়। আমার কাছে তুমি সবার উর্ধ্বে। প্রতিটি মেয়ের কাছেই না-কি স্বামী ফার্স্ট প্রায়োরিটি। কিন্তু তুমি আমার স্বামী বলে নয় আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি তাই তুমি আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি, তোমার কষ্টে আমার কষ্ট হয়, বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা হয়। তোমাকে আমি কষ্টে থাকতে দেখতে পারি না। তুমি ছাড়া সব কিছু আমার কাছে তুচ্ছ। তুমি আমার হৃদয়ে, অনুভবে, শিরায়, রক্তে গভীর ভাবে মিশে আছো।” ( মেহেরের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে)
ফায়াজ মেহেরকে বুকে চেপে ধরে বলল,
“মেহের, আমার ব্যাপারটাও একি রকম। তুমি কষ্ট পেলেও আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি কান্না থামাও। আমি ঠিক আছি। তোমার ভালোবাসাই আমাকে রোজ অনুপ্রেরণা দেয় নতুন করে স্বপ্ন দেখার। আমি একটুও কষ্ট পাচ্ছি না মেহের। তুমি আছো তো।”
দুজন অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর ফায়াজ ঘড়ি দেখল। ন’টা পার হয়ে গেছে। অফিসে যাওয়াটা জরুরি। যদিও ভালো লাগছে না।
“মেহের, উঠ। অফিসে যেতে হবে।”
মেহের নাক বাজিয়ে বলল,
“যেতে হবে না।”
“অফিস কেন মিস দেব শুধু শুধু? কাজ আছে আমার।”
মেহের দুম করে উঠে বলল,
“খালি কাজ, কাজ, অফিস। দূর ভাল্লাগে না। আমি যাচ্ছি। যাও তুমি অফিস।”
ফায়াজের মনে পড়ল এই কাজ, ব্যস্ততা নিয়েই বাবা-মায়ের প্রায় ঝগড়া হতো। তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরে। এর জন্যই তাদের সুখের সংসারে আগুন লেগেছে।
নাহ, ফায়াজ পরিবারের আগে কাজকে প্রায়োরিটি দিতে চায় না। ও চায় না মেহেরের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হোক। মেহের তো কখনও কাজ নিয়ে অভিযোগ করে না। অসময়ে কোন রকম অপ্রয়োজনীয় আবদারও করে না। তাই আজ মেহেরের কথা শোনা উচিত।
ফায়াজ উঠে মেহেরের হাত ধরে বলল,
“ঠিক আছে জান যাব না আজ অফিসে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তাই করব আজ।”
“না, যাও অফিসে। আমার কথা শুনতে হবে না।”
“আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ। তার উপর এত সুন্দরী। তার কথা শুনবো না তো কার কথা শুনবো?”
মেহের ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
“ঢং করতে হবে না।”
ফায়াজ বিছানা থেকে নেমে মেহেরকে কোলে তুলে নিয়ে আবারও বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চেপে ধরে বলল,
“মিস. লাল টমেটো। তুমি এত কিউট কেন? যখন রাগার ভান করো না তোমাকে হেব্বি লাগে। শুধু হেব্বি না লোভ লাগে।”
“কারণ তুমি লোভী। প্রচন্ড লোভী।”
ফায়াজ মেহেরকে পরম ভালোবাসায় আগলে বলল,
“তোমার লোভ আমার আজীবন থাকবে।”
দুজন একসাথে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর মেহের অনুভব করল ফায়াজ ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহের নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে গেল। ফায়াজের কপালে আলতো করে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে বলল,
“রেস্ট করাটা তোমার জন্য জরুরী।”
কয়েক দিন পরের কথা। ফায়াজ আগের মতোই নরমাল বিহেভ করছে। বিকেল বেলায় দু’জন বাগানে বসে আছে। মেহের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে বই পড়ছে। কিছুদিন পরে থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা। ফায়াজ ওর খরগোশ জোড়াকে খাওয়াচ্ছে। আর ওরা খেলছে। ফায়াজ ওর খরগোশের জন্য আরেকটা খরগোশ এনেছিল কিছুদিন পরে। ফায়াজ একটা খরগোশকে তুলে নিয়ে কিছুটা দূরে রেখে আসে। এই খরগোশটা দৌড়ে ওর কাছে চলে যায়। ফায়াজ একি কাজ বারবার করছে। একবার এ পাশের খরগোশ তো আরেকবার ওপাশের খরগোশ দৌড়ে আবার এক হয়ে যায়।
ফায়াজ হাসতে হাসতে মেহেরের সামনে গিয়ে বলে,
“দেখেছো একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারছে না।”
মেহের বই থেকে চোখ তুলে বলল,
“কারা?”
ফায়াজ এক আঙুল তুলে বলল,
“ওয়েট দেখাচ্ছি।”
ফায়াজ মেহেরকে পুরো ঘটনা রিপিট করে দেখাল। তারপর মেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
“দেখেছো এরা একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারছে না। এই প্রেমিক যুগলকে আলাদা করতেই পারছি না। কি করা যায় বলো তো?”
মেহের বই রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার এত হিংসা লাগছে কেন? এমন তো নয় তোমার নিজের বউ নেই। এক কাজ করো ওদের বিয়ে দিয়ে দেও।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে হোহো করে হেসে ফেলল।
“ভালো বলেছো। এদের বিয়ে দিয়ে দেই কেমন?”
ফায়াজ আর মেহের একসাথে খরগোশদের সাথে খেলায় মেতে উঠল।
হটাৎ করে মেহেরের ফোন বেজে উঠল। মেহের ওদের ছেড়ে উঠে বইয়ের পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখে ফাইজার কল। মেহের ফায়াজের দিকে একবার তাকায়। ফায়াজ ওদের সাথে ব্যস্ত। মেহের ফোন রিসিভ করে আরেকটু দূরে গেল।
“কেমন আছো? ”
ফাইজা বিষন্নতা নিয়ে বলল,
“এই তো ভালোই আছি। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
ফাইজার কন্ঠস্বর মেহেরের ভালো ঠেকছে না। মনে হচ্ছে ওর মন খারাপ।
“হ্যাঁ বলো।”
ফাইজা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,
“আমরা চলে যাচ্ছি। পরশু রাতে আমাদের ফ্লাইট। শেষ মুহূর্তে প্যাকিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। হয়তো বলতে ভুলে যাব৷ তাই আগেই জানিয়ে রাখলাম৷ দোয়া করো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“ফাইজা, কি বলছো?”
“হ্যাঁ ভাবি। এখানে আমাদের মা-মেয়ের আর কি আছে। তাই চলে যাচ্ছি। পাপা আর ভাইয়াকে দেখো। ভালো থেকো।”
ফাইজা ফোন রেখে দিল। মেহের ফোনের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওরা চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই পরিবারকে এক করতে পারল না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। তবে চেষ্টা করেছিল অনেক৷ মেহের জানে ফায়াজ যাই বলুক ও ওর পরিবারের সাথেই ভালো থাকত। ওর প্রয়োজন ওর পরিবারকে।”
“কি হয়েছে? কার ফোন?”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫১
মেহের ফায়াজের কথায় চমকে যায়। ফায়াজকে বলতে ইচ্ছে করছে না। ফায়াজ এতদিনে একটু নরমাল হয়েছে।
“কই কিছু না। এমনি ফোন ছিল।”
“মেহের, লুকিও না। তোমার ফেস দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কিছু হয়েছে। কি হয়েছে বলো আমাকে?”
মেহের জানে ফায়াজ না জানা পর্যন্ত ছাড়বে না। আর ফায়াজকে মিথ্যা বলতে চায় না।
“ফাইজার ফোন ছিল। পরশু রাতে ওদের ফ্লাইট।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে মুখ ভার করে নিল। কোন টু শব্দ করল না। চুপচাপ হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।