শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৩ || sesh patai tumi golpo

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৩
ফাবিহা নওশীন

রৌদ্দমাখা দুপুর। সূর্যের প্রখরতা জানান দিচ্ছে হুট করেই ঝড় বইতে পারে। স্বচ্ছ নীলাভ আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ ভাসছে। মনে হচ্ছে শরতের এক গুচ্ছ কাশফুল অথবা শুভ্র পাজা তুলো। ফায়াজ অফিসের এসি ঘরে বসেও গ্রীষ্মের উত্তাপ অনুভব করতে পারছে জানালা দিয়ে। জানালা দিয়ে রোদ পড়ছে ঘরের ভেতর। জানালা হাট করে খোলা তথাপি সাদা পর্দাটা সরানো। ও ইচ্ছে করেই জানালাটা খোলা রেখেছে। স্বচ্ছ আকাশটা অনুভব করছে না নিজের প্রিয় কিছু হারানোর আশংকা করছে সেটা ভাবার সময় নেই ওর। অনিচ্ছা স্বত্তেও ফাইলপত্র খোলে বসল৷ নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এই ব্যস্ততাই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ফায়াজ ফাইলপত্র ঘাঁটছে এরি মধ্যে পিয়ন এসে বলল,
“স্যার একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। বলছে কিছু দরকারী কথা বলবেন।”

ফায়াজ হুট করে বুঝতে পারল না কে এসেছে। আজ তো কারো সাথে মিটিং নেই, কোন ক্লাইন্টের আসার কথা না। তাহলে কে হতে পারে?
ফায়াজ ব্রেইনে প্রেশার দিয়েও জানতে পারল না কে হতে পারে। পিয়নের দিকে চেয়ে বলল,
“ভদ্রমহিলার নাম কি?”
পিয়ন ফায়াজের দিকে চেয়ে আহাম্মকের মতো বলল,
“স্যার, জিজ্ঞেস করে আসব? আসলে উনার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।”
ফায়াজ পিয়নের দিকে বিরক্ত চোখে তাকাল তারপর বলল,
“দরকার নেই। আসতে বলুন।”
পিয়ন ফায়াজের অনুমতি নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল৷ ফায়াজ ফাইল বন্ধ করে দরজার দিকে চেয়ে রইল। সিনেমা, মুভি হলে এই মুহুর্তে ফায়াজের ফাইলে মুখ গুজে থাকার কথা৷ কিন্তু ফায়াজ তা করছে না। কাজে মন বসছে না তাই জোর করে মন বসানোর চেষ্টা না করাই শ্রেয়। তার চেয়ে বরং কে এসেছে সেটা জানার জন্য কৌতূহল হোক৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

কিছুক্ষণের মধ্যেই ৪৭-৪৮ বছর বয়সী এক মহিলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল৷ তার পরনে ধূসর রঙের সুতি শাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ চুলে পাক ধরেছে৷ সামনের দিকে কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা চুল দেখা যাচ্ছে৷ এই চুলগুলো চাইলেই তিনি কলপ করতে পারতেন। কিন্তু করেন নি। বাম কাঁধে ছোট একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। ফায়াজ ভদ্রমহিলাকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ও যেন থমকে গেল। সাথে ওর পুরো পৃথিবীটাও।
কিছুক্ষণ পরে ফায়াজের হুশ ফিরলে বলল,
“আপনি!”
ফায়াজের মা এসেছেন। তিনি আপনি কথার উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকল৷ কোনরুপ পারমিশন নিল না৷ এর জন্য যদি কথা শুনতে হয় তবে তাই হোক। তবুও ভেতরে ঢুকবে। কিছু কথা বলবে।
ফায়াজ কেন জানি অদ্ভুত কিছু অনুভব করছে। ওর এখন রাগে ফেটে যাওয়ার কথা। চিৎকার, চেচামেচি করে অফিস মাথায় তোলার কথা কিন্তু পারছে না। অদৃশ্য শক্তি বাঁধা দিচ্ছে প্রবল ভাবে।
“কেমন আছো?” শীতল কণ্ঠে ফায়াজের টনক নড়ে৷ কিন্তু এ কথার জবাব দিতে পারে না।

ফায়াজের মা বিমর্ষচিত্তে বলল,
“জানি এই প্রশ্ন করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি তোমার ভালো থাকার অবলম্বনগুলো কেড়ে নিচ্ছি। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। ফায়াজ বিশ্বাস করো আমি চাই নি আমার জন্য তোমাদের ভাই-বোনের সম্পর্কে কোন বিরুপ প্রভাব পড়ুক। আমি ফাইজাকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ও বুঝতে চাইছে না। হয়তো বুঝতে পারছে কিন্তু অভিমান করে আছে। তবে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে ঠিক তোমার মতো।”
ফায়াজ দৃষ্টি নত করে রেখেছে। রাগটা ভেতরে একান্তে রেখেছে। এই মুহুর্তে মা নামক ভদ্রমহিলার কাছে প্রকাশ করতে চাইছে না।
“ফায়াজ!” অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ চোখ তুলল না।

“ফায়াজ, আমি তোমার মা। ১৬বছর তোমাকে কাছে পাই নি। আমি চাই নি তোমাকে ছেড়ে যেতে৷ কোন মা তার সন্তানকে ছাড়তে চায়? আমি ভেবেছিলাম ফাইজাকে নিয়ে সেটেল হয়ে তোমাকে সুযোগ বুঝে নিয়ে আসব। বুঝতে পারি নি কিছু দিনের ব্যবধানে তুমি আমার উপর এতটা রাগ, অভিমান পুষে ফেলবে। বিশ্বাস করো আমি সত্যি বুঝিনি। এটাই আমার জীবনের বড় ব্যর্থতা। মা হয়ে সন্তানকে বুঝি নি।” (কাঁদতে কাঁদতে বলল)
সন্তান যতটাই রাগ করে থাকুক না কেন বাবা-মাকে কষ্টে দেখতে পারে না। তাদের চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। এই মুহুর্তে ফায়াজের ক্ষেত্রেও সেটা হচ্ছে।
“ফায়াজ আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলাম না বিশ্বাস করো। তুমি যদি আমাকে না চাও, আমাকে ছাড়া ভালো থাকো তবে আমি কোনদিন তোমার সামনে আসব না, তোমার ভালো থাকার পথে বাঁধা হব না। দূর থেকে তোমার জন্য শুভকামনা করে যাব। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দেও।” ( হাত জোড় করে)
ফায়াজ তখনও চুপ। কোন জবাব দিচ্ছে না।
ফায়াজের মা চোখের পানি মুছে বলল,

“আমরা চলে যাবার পর তুমি প্লিজ ফাইজার সাথে যোগাযোগ করো। অভিমান করে আছে। একমাত্র তুমিই পারো ওর অভিমান ভাঙাতে। তুমি একবার ওর সাথে কথা বললে ওর অভিমান ভেঙে যাবে। বড্ড ভালোবাসে তোমাকে। আমি চাই তোমাদের সম্পর্কটা আগের মতো হয়ে যাক। আমার মতো খারাপ মায়ের জন্য ভাই-বোনের মধুর সম্পর্ক নষ্ট হবে কেন? আমার জীবনে আর কি আছে। তোমাদের ভালো থাকার উপর চেয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।”
ফায়াজের মা কাঁধে ব্যাগ চেপে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আসছি ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। মেহেরের যত্ন নিও। ও বড্ড ভালো মেয়ে। দোয়া করি তোমরা সব সময় ভালো থেকো। হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। মরে গেলে ছেলের হাতের মাটিও হয়তো পাব না। তবে ফাইজার খোঁজ রেখো।”

ফায়াজের মা মন ভরে ফায়াজকে দেখে নিল। ঠিক মন ভরে না। সন্তানকে দেখে কোন মায়েরই মন ভরে না, তৃপ্তি মিটে না। চোখের পানি মুছতে মুছতে দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। যতই সামনের দিকে হাঁটছেন বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিড়ে রক্তাক্ত করে ফেলে চলে যাচ্ছেন। ফায়াজ মাথা তুললো না। মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছল। তারপর নিজেকে কড়াসুরে শাসন করল।
“ফায়াজ, কার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? কার জন্য চোখের পানি ফেলছিস? তোর চোখের পানি কি এতটাই তুচ্ছ আর যার তার জন্য ঝড়ে। আমি আর কষ্ট পাব না। ভালো থাকব খুব ভালো থাকব।”

~পরের দিন সকালে~
ফায়াজ উপর তলার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। ফায়াজের মা ঝাপসা চোখে বাড়ির এ কোনা থেকে অন্য কোনা দেখছে। যতই দেখছে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। কতদিন পরে নিজের সংসারে পদধূলি পড়েছে। চোখে পানি টলমল করছে। এখনি বুঝি বর্ষণ হয়ে ঝড়ে পড়বে।
মেহের ফায়াজের পেছনে এসে দাঁড়াল। নিচে ফাইজা আর শাশুড়ীকে দেখে অবাক হলো। তারপর আবার ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজের কোন ভাবান্তর নেই। মেহেরের খটকা লাগছে। ফায়াজ মেহেরকে এভয়েড করে রুমে চলে গেল।
মেহের দ্রুত পায়ে নিচে নামল। নিচে নামতেই ফাইজা এসে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল।
“ওহহহ,, ভাবিহহহহ! আমরা চলে এসেছি। এতদিন পরে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। ভাইয়া নিজেই আমাদের আসতে বলেছে। সব ঠিক হয়ে গেছে। ভাইয়া মমকে মেনে নিয়েছে। আমার যে কি মজা লাগছে। তোমাকে বুঝাতে পারছি না।”

ফাইজার কথা মেহেরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। সন্দেহ নিয়ে ফাইজার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুচকি হাসল। ফাইজার খুশিটা নষ্ট করতে চায় না। মেহের শাশুড়ী মা’কে সালাম করে কুশলাদি জানতে চাইল। তারপর রুমে গিয়ে রেষ্ট করতে বলল৷ মেহের গেল ফায়াজের কাছে। ফায়াজ গলায় টাই বাঁধছে। মেহের ফায়াজের কাছে এগিয়ে যেতেই ফায়াজ নিজ থেকে বলল,
“আমি জানি তুমি কি বলবে। হ্যাঁ আমি ওদের আসতে বলেছি। বাবাকে বলেছি ওদের নিয়ে আসতে।”
হুট করে ফায়াজ সব মেনে নিয়েছে বিষয়টা হজম হচ্ছে না। মেহেরের চোখে বিস্ময় দেখে বলল,
“তবে শুধু ফাইজার জন্য। ওকে আমি কষ্টে দেখতে পারছিলাম না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর অন্য কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে মনে মনে বলছে,

“এসে যখন পড়েছে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ফায়াজের অভিমানের পাহাড় গলবে। গলে পানি হয়ে মিশে যাবে।”
ফায়াজ টাই বেঁধে আচমকা মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি আমার পাশে থেকো তাহলেই হবে। আমি শক্তি পাব, সাহস জোগাব। আসছি জান।”
মেহেরের কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিল আর ফায়াজকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিল।

পরের দিন মেহের ভার্সিটির ক্লাস শেষে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। ব্যাগটা রেখে চোখে-মুখে পানি দেয়। পানিতে ভেসিনের আয়না ভিজে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতেই পেছনে কাউকে দেখতে পায়। তবে অস্পষ্ট। দেখার জন্য ঘুরতে গেলেই মেহেরের মুখে স্পে করে দেয় মানুষটি। মেহের লুটিয়ে পড়ে।
ড্রাইভার মেহেরের জন্য অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত। এই ক্লান্ত মনে মেহেরের নাম্বারে ফোন করে সুইচড অফ পেয়ে ফায়াজের নাম্বারে ফোন করে। ফায়াজ সব কাজ কমপ্লিট করে বেরুবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ মেহেরের ৪টা অবধি ক্লাস ছিল৷ আরেকটু আগে নিজের কাজ কমপ্লিট করতে পারলে মেহেরকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে পারত।
টেবিলের উপর ফায়াজের ফোনটা বেজে উঠল। বাজার সাথে সাথে রিসিভ করে।

“স্যার, ভাবিরে পাইতেছি না। ফোন বন্ধ। ভার্সিটিতেও নাই।”
এই ছোট ছোট লাইনগুলো ফায়াজের উপর ভারী পড়ল। ফায়াজ সাথে সাথে ফোন কেটে মেহেরকে ফোন করছে। ওর ফোন অফ। ফোন অফ পাওয়ায় বুকটা ধুক করে উঠল। মেহেরের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। মাথা কাজ করছে না। দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫২

উদ্ভাটের মতো গাড়ি ছুটছে। আর যাকে পাচ্ছে ফোন করছে। সামিরাও কিছু জানে না। একটা জলজ্যান্ত মানুষ ভার্সিটি থেকে উধাও কি করে হয়।
মেহেরের জ্ঞান ফিরতেই অন্ধকার রুমে নিজেকে দেখতে পেল। মাথাটা কেমন ভারী লাগছে। তবে জায়গাটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মেহের উঠে দাঁড়াল। এখানে কি করে এলো? মেহেরের আগের ঘটনা মনে পড়ল। কেউ ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন? আর সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা ওর হাত, পা কিছুতেই কোন প্রকার বাঁধন নেই। রুমের ভেতরে পুরনো আসবাবপত্র, বেঞ্চ, বড় বড় বস্তা এটা সেটা দিয়ে পূর্ণ। আর দেয়ালের রঙ বলছে এটা ভার্সিটির কোন এক রুম।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.