শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৫
ফাবিহা নওশীন
ফায়াজ পাজা কোলে মেহেরকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। ওরা ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিল মেহেরের জন্য। মেহেরকে কোলে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফাইজা আর ওর মা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো।
“ভাইয়া ভাবির কি হয়েছে?”
ফায়াজ উপরে যেতে যেতে বলল,
“সেন্স হারিয়েছে। ডাক্তার ডাক।”
ফায়াজ রুমে নিয়ে মেহেরকে শুইয়ে দিল। ফায়াজের পেছনে পেছনে তুষার, সামিরা আর ফায়াজের মা ঢুকল। ফায়াজ জগ থেকে পানি নিয়ে মেহেরের চোখে-মুখে পানি ছিটা দিল।
তবুও মেহেরের সেন্স ফিরছে না। ফাইজা ফোন করতে করতে ঘরে ঢুকল।
“ভাইয়া ডাক্তার আসতেছে।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল তারপর আবারও পানি ছিটা দিল ওর চোখে-মুখে। মেহের নড়ে-চড়ে উঠে। সেটা দেখে সবাই এগিয়ে এল। মেহের ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখ খুলেই ফায়াজকে দেখতে পেল।
ক্লান্তস্বরে বলল,
“ফায়াজ!”
ফায়াজ মেহেরের পাশে বসে বলল,
“হ্যাঁ বলো।”
মেহের আরেকটু নড়ে-চড়ে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করে বলল,
“আমি বাড়িতে?”
“হ্যাঁ তুমি বাড়িতে। আর একদম সেফ আছো। ভয় পেও না। তুমি একদম সেফ।”
ফাইজা কথা বলতে এলে ফায়াজ ইশারা করে না করল। ফাইজা থেমে গেল। মেহের অনেক ক্লান্ত এখন কিছু না জিজ্ঞেস করাই শ্রেয়।
ফায়াজ ফাইজাকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সবাই একটু বাইরে গেলে ভালো হত।”
ওরা একে একে সবাই বাইরে চলে গেল। ফায়াজ দরজাটা বন্ধ করে মেহেরের কাছে এলো।
ফায়াজ মেহেরের কাছে যেতেই মেহের জড়ানো কন্ঠে বলল,
“কে জানি আমাকে ওই ঘরে আঁটকে রেখেছিল। আমি…. ”
“হিসসস! কথা বলো না৷ কিছু বলতে হবে না। তুমি এখন চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি পরে সব শুনব। এখন রেস্ট নেও।”
মেহের খুক খুক করে কেশে উঠে। ফায়াজ পানি নিয়ে আসে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। মেহের পানি খেয়ে ম্লান কন্ঠে বলল,
“আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে মায়া কাজ করছে। ক্ষুধা তো লাগবেই দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি।
“আমি বলছি খাবারের কথা। তুমি শুয়ে থাকো আমি আসছি।”
ফায়াজ মেহেরের খাবারের কথা বলতে ঘর থেকে বের হলো। ফাইজা ডাক্তার নিয়ে ফায়াজের ঘরের দিকে আসছে। ফায়াজ দেখতে পেয়ে বলল,
“এসে পড়েছেন? আসুন আমার সাথে। ফাইজা মেহেরের খাবারের কথা বল।”
“ভাইয়া, মম খাবার নিয়ে আসতেছে।”
ফায়াজ আর কথা বাড়াল না। ডাক্তার মেহেরকে চেকাপ করে বলল,
“স্ট্রেস থেকে এমন হয়েছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
ফায়াজের বন্ধুরা বিদায় নিয়েছে। মেহেরের বাবা-মা থেকে গেছে। মেয়ের এই অবস্থায় তারা যেতে পারেন নি। মেহের খেয়ে একটু ঘুমিয়েছে।
ফায়াজের খেতে ইচ্ছে করছে না। কে, কি করেছে না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই। ওর রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। কে এমন সাহস করল কিছুই বুঝতে পারছে না।
ফায়াজ ঘুমন্ত মেহেরের মুখের দিকে তাকাল। ঘুমের মধ্যেও ওর মুখটা ক্লান্ত লাগছে। কেমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ফায়াজ ধীরে ধীরে মেহেরের কাছে গেল। মেহেরের চোখে-মুখে চুমু খেল। আলতো করে জড়িয়ে ধরল।
সারা শরীর যেন কাঁপছে। আজ ওর প্রাণভোমরাকে হারানোর ভয়ে আতংকিত হয়েছিল। সত্যিই যদি হারিয়ে ফেলত তাহলে কি হতো ভাবতে পারছে না। নিশ্বাস নিতে পারছে না। চোখে পানি টলমল করছে। গলার কাছে স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
মেহের ফায়াজের পিঠে হাত রেখে বলল,
“আমি ঠিক আছি।”
মেহেরের জাগ্রত কন্ঠ শুনে ফায়াজ মেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেহের বাঁধা দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে তরল পদার্থের অনুভব করে মেহের নড়ে উঠল।
“ফায়াজ, কাঁদছো কেন? আমি তো ঠিক আছি। কিছু হয় নি আমার। আর তোমার পাশেই আছি, তোমার বুকে। তবে কাঁদছো কেন?”
ফায়াজ কথা বলতে পারছে না। নীরব কান্নায় হটাৎ করে ফায়াজের ফ্যাসফ্যাস শব্দ ভেসে আসছে।
মেহের আবারও বলল,
“তুমি আমার কথা শুনছো না কেন? আমিও কিন্তু এখন কেঁদে ফেলব। আমাকে বলো আমি নাকি অযথা ভ্যা ভ্যা করি। কাদুনি মেয়ে। তবে তুমি এখন বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন?”
ফায়াজ মাথা তুলে মেহেরের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজের পুরো মুখে পানির ছাপ পড়ে গেছে। চোখের পাপড়িগুলো ভিজে ভার হয়ে গেছে।
“মেহের অনেক ভয় পেয়েছি আজ। এর আগে আমি এত ভয় পাই নি। কাছের মানুষের মৃত্যু কতটা ভয়ংকর অনুভূতি সৃষ্টি করে আজ বুঝেছি।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“আমি তো মরে যাই নি। বেঁচে আছি।”
ফায়াজ চোখ মুছে বলল,
“পুকুরে তোমার ব্যাগ পাওয়া গেছে। ওরা বলছিলো তুমি পুকুরে….
ফায়াজের গলা জড়িয়ে এলো। পরের টুকু বলতে পারল না।
মেহের ফায়াজের কথা শুনে বলল,
” পড়ে মরে গেছি?”
ফায়াজ চোখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পরে বলল,
“আমি তো আজ কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমিই জানি। অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি ছাড়া আমার আমি বলতে কিছু নেই। দীর্ঘ সময় পর কাউকে নিজের ভেবেছি, ভালোবেসেছি। মেহের তুমি যে আমার কি সেটা তুমিও জানো না। অনেক অসহায় লাগছিল যখন তোমার জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না। বাইরে শক্ত থাকলেও ভেতরটা খা খা করছিল। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।”
ফায়াজ চোখের পানি মুছে বলল,
“কখনো হারিয়ে যেও না মেহের সইতে পারব না। আজ আমি অনুভব করেছি ভুমিহীন আমি বাঁচতে পারব না। পাগল হয়ে যাব। ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমার কিছু নেই।”
ফায়াজের কান্না দেখে মেহেরও কাঁদছে। ফায়াজকে বলল,
“চুপ করো। এসব বলো না।”
ফায়াজ চোখের পানি মুছল। কিছুদিন যাবত শুধু কাঁদতেই হচ্ছে। ওর সামনে এমন সব ঘটনা ঘটেছে না কেঁদে উপায় নেই। কত বছরের জমানো কান্না কে জানে!
ফায়াজ চোখের পানি মুছে মেহেরকে একটু সরিয়ে বলল,
“কি হয়েছিল? কিভাবে ওই ঘরে আঁটকে গিয়েছিলে? আর ওই ঘরে কেন গিয়েছিলে? আমার জানামতে ও ঘর সব সময় বন্ধ থাকে।”
মেহের থমথমে মুখে বলল,
“আমি যাই নি। কেউ নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কে নিয়েছে জানি না।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে চমকে তাকাল। কিছুই বুঝতে পারছে না। এতক্ষণ তো ভেবেছে কোন ভাবে আটকা পড়েছিল।
“মানে? কে নিবে? আর কেন?”
মেহের দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলল,
“সত্যিই জানি না। আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। মুখে পানি দিচ্ছিলাম। পেছনে কেউ একজন ছিল কিন্তু আয়নায় পানি ছিল তাই চেহেরা বুঝতে পারি নি। দেখার জন্য পেছনে ঘুরতেই মুখে স্পে করে। তারপর আর মনে নেই। জ্ঞান ফিরে ওই বদ্ধ ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করি। তবে অদ্ভুত বিষয় আমি যেমন ছিলাম তেমনই নিজেকে পেয়েছি। শরীরে মাটি, ময়লা কিংবা হাত-পা বাঁধা ছিল না। আর ভার্সিটির ওই রুমে আটকে রেখে এলো কেন? কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ফায়াজও বুঝতে পারছে না। কেউ কেন ওকে ভার্সিটির একটা রুমে আঁটকে রেখে আসবে? ফায়াজের মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।
উঠে বসে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“যে কাজটা করেছে ঠিক করে নি। এর মাশুল দিতে হবে। আমাকে আর তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ভয়ানক মাশুল দিতে হবে। এর হিসেব আমি চুকিয়ে নেব অপেক্ষা শুধু ওকে খুঁজে পাবার। সেটা তো আমি খুঁজে নেব।”
মেহের কোন প্রতিউত্তর করল না। কে এই কাজটা করেছে এবং কেন করেছে সেটা ওর ও জানা প্রয়োজন।
সকাল সকাল পুলিশ এসে হাজির। ড্রয়িংরুমে পুরো পরিবারের ভীড়। মেহের পুলিশকে বরাবরই ভয় পায়। ওদের সামনে যেতে ভয় লাগছে। মেহেরের পাশে ফাইজা বসে আছে। ফায়াজ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরের নার্ভাস লাগছে।
“আপনার সাথে কি হয়েছিল বলুন তো?”
গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে মেহেরের বুক কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় শর্টকাট করে পুরো ঘটনা বলল।
অফিসার মেহেরের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল,
“আপনি তাকে দেখেন নি?”
“জি না।”
“ছেলে না মেয়ে ছিল তাও জানেন না?”
“জি না।”
অফিসার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল,
“এটা কি করে হতে পারে? আপনার পেছনে ছিল আর আপনি বলতেই পারেন না তিনি ছেলে না মেয়ে।”
মেহের ঢোক গিলে বলল,
“আমি শুধু একটা ঝাপসা অববয় দেখেছি। ভালো করে দেখার আগেই চোখে স্পে মারে।”
অফিসার সন্দেহ নিয়ে বলল,
“বিষয়টা এত দ্রুত হয়েছে যে আপনি তাকে দেখেন ই নি? ঘুরলেন অথচ দেখলেন না? এমন নয়তো আপনি জানেন কিন্তু বলছেন না।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কেন বলব না?”
“কারণ আপনি তাকে বাঁচাতে চাইছেন। সে আপনার পরিচিত কেউ।”
মেহের এমন উত্তরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। প্রায়ই কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,
“জি না। আমি তাকে দেখি নি।”
অফিসার তবুও সন্দেহ নিয়ে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“ভয় পাবেন না। যদি জেনে থাকেন সে যে তবে তার নামটা বলুন।”
মেহের জবাব দেওয়ার আগেই ফায়াজ সামনে এগিয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে চুটকি বাজিয়ে বলল,
“আউট। যথেষ্ট ইনভেস্টিগেশন করেছেন। এখন যেতে পারেন।”
অফিসার ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সবার দিকে এক বার তাকিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে ফায়াজকে বলল,
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। আমি আইনের লোক।”
ফায়াজের রাগে শরীর জ্বলছে। চোখ-মুখ লাল করে বলল,
“তাতে হয়েছে টা কি? মাথা কিনে নিয়েছেন?”
মেহের বড়বড় চোখ করে ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে। ফাইজা ফিসফিস করে বলছে, ভাইয়া ঠিক করেছে। এই ব্যাটার মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে।”
ফায়াজ আবারও বলল,
“ইনভেস্টিগেশনের নামে তামাশা শুরু করে দিয়েছেন আবার আসছে আইনের লোক।”
ফায়াজের বাবা ফায়াজকে ধমকে বলল,
“চুপ করো। রেস্পেক্ট দিয়ে কথা বলো।”
“বাবা কি রেস্পেক্ট দেব? বারবার কি একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। মেহের যখন একবার বলেছে যে দেখেনি ব্যাস দেখেনি। সারাটা দিন একটা অন্ধকার ঘরে বন্দী ছিল। অনেক চেষ্টার পর সেখানে থেকে বের হতে পেরেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর উনি কিসব বলে যাচ্ছেন। উনারা খুঁজে বের করতে পারছে না উল্টো পালটা প্রশ্ন করে ইনভেস্টিগেশন দেখাচ্ছে। স্ট্রেঞ্জ।”
অফিসার দমে গিয়ে বলল,
“আপনার ধারণা ভুল। আমরা আমাদের কাজ করছি। খুব শীঘ্রই অপরাধীকে খুঁজে পাব।”
ফায়াজ মনে মনে বলছে,
“না পেলে তোর খবর আছে। শুধু বড়বড় কথা।”
অফিসার যাওয়ার পর মেহেরকে বলল,
“তোমার কিছুদিন বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ওকে পাওয়া যাক তারপর আবার ভার্সিটিতে যাবে।”
মেহের আপত্তি জানাল না। ও নিজেও যেতে সাহস করছে না।
ফাইজা ফোন ঘাটতে ঘাটতে নিজের রুমে যাচ্ছে।
ফায়াজ ফাইজাকেও উদ্দেশ্য করে বলল,
“ফাইজা!”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৪
ফাইজা ফায়াজের ডাকে সাড়া দিতে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলল,
“কি ভাইয়া?”
“তোরও বাইরে যাওয়া বন্ধ। এদিক সেদিক উড়াউড়ি করা যাবে না। বাড়িতেই থাকবি।”
ফাইজার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
“আমি? আমি কেন?”
ফায়াজ ফোন বের করে তুষারের নাম্বারে ডায়েল করতে করতে বলল,
“বের হলে ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখব।”
ফাইজা অসহায় ফেস করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তুষার ফায়াজের কাছে সব ঘটনা শুনে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে এসবের পেছনে ভয় দেখানো ছাড়া অন্য আর কোন ইনটেনশন ছিল না। নয়তো মেহেরের কোন ক্ষতি করে নি। ভার্সিটির রুমেই আটকে রাখল। অদ্ভুত না?”
“হ্যাঁ। অদ্ভুত। কিন্তু কে এমন করল? তাকে আমার চাই। যেকোনো মূল্যে চাই।”
Khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub sundor hoeache khub khub khub khub khub khub khub valo legeche