শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৬ || ফাবিহা নওশীন

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৬
ফাবিহা নওশীন

সকাল সকাল ফায়াজের মুড খারাপ। অফিসে যাবার জন্য রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে কফি খাচ্ছে। মেহের এসে ফাইজার পাশে বসল।
সকাল বেলায় থানা থেকে কল এসেছে অপরাধীকে এখনও ধরা যায় নি। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চেক করে কিছু জানা যায় নি। কারণ অপরাধী সব কিছু প্লানিং করেই করেছে। পাকা খেলোয়াড় সে। সিসি ক্যামেরা অফ ছিল। তাই কিছু পাওয়া যায় নি। আর কাউকে সন্দেহও হচ্ছে না। অফিসারের মুখে এসব শুনে মন তিক্ততায় ভরে গেছে। মনে মনে অফিসারকে দু-চার গালি দিয়ে ফোন কেটে দেয়। ফায়াজ নিরিহ স্বভাবের মানুষ হলে পরিস্থিতি মেনে নিতো কিন্তু ও যে অস্থির প্রকৃতির মানুষ তাতে ধৈর্য ধারণ ওর কাম্য নয়। ওর মাথায় শুধু ওই ব্যক্তিকে মনের স্বাদ মিটিয়ে কি করে সাইজ করবে তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এত সহজে সেদিনের ঘটনা ভোলার নয়। স্মৃতি থেকে কিছুতেই মুছবে না।

নাস্তার টেবিলে গরম খিচুড়ি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মুরগী, গরুর মাংস ভোনা হয়েছে। সাথে ভাজা ইলিশ আর বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। মেহের চোখ বড়বড় করে সেদিকে চেয়ে আছে। এত পদের ভর্তা কে বানালো?
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“এত ভর্তা কে বানালো?”
ফাইজা উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
“মম বানিয়েছে। নাস্তার সবকিছুর আয়োজন মম করেছে৷ আর এই ভর্তাও নিজের হাতে বানিয়েছে। ইতালিতে প্রায়ই আমাকে বানিয়ে খাওয়াতো। আর আজ তোমার আর ভাইয়ার জন্য বানিয়েছে। খেয়ে দেখো খুব মজা।”
মেহের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তাই!”
ফায়াজ চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইজা আর মেহেরের গল্পের ইতি ঘটল। দুজনেই ফায়াজের আকস্মিক দাঁড়িয়ে যাওয়ার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টিই এক দিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

ফায়াজ কোর্ট পরে মেইনগেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওর মা রান্নাঘর থেকে বাটি নিয়ে আসছিলেন। ফায়াজকে এভাবে চলে যেতে দেখে দৃষ্টি স্থির করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফায়াজকে ডাকল। কিন্তু ফায়াজ ঘুরেও তাকাল না। মেজাজ খারাপ তার উপর ফাইজার এমন আহ্লাদী কথাবার্তায় মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেছে।
ততক্ষণে মেহেরও টেবিল ছেড়ে এসেছে। ফায়াজের মা মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরতার দৃষ্টি বুঝতে পেরে দ্রুত পায়ে বাড়ির বাইরে গেল। ফায়াজ গাড়ির দরজা খুলছে।
মেহের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“ফায়াজ, দাঁড়াও।”
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে মেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
“কি হয়েছে? আমার অফিসে কাজ আছে। তাড়াতাড়ি বলো।”
“নাস্তা করবে না?”
“সময় নেই। অফিসে করে নেব।”
“সময় নেই না মা রান্না করেছে তাই খাবে না?”

ফায়াজ উত্তর না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। মেহের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে গেল। ওর শাশুড়ী মা কাঁদছেন। ফাইজা আর ওর বাবা শান্তনা দিচ্ছে। মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাছে গেল।
চোখের পানি মুছে মেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
“ফায়াজ আমাকে এখনো ঘৃণা করে তাই না মেহের? আমি চলে যাব। ছেলে যখন চায় না আমি থাকব না।”
মেহের পাশে বসে হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“কেন চলে যাবেন? এটা আপনার বাড়ি, আপনার সংসার। আবার চলে গেলে সেটা আপনার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল হবে। যা আর কোনদিন শোধরাতে পারবেন না। পরিবারটা আবারও জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা শুধু সময়ের। ধৈর্য ধরতে হবে।”
ফায়াজের বাবা বলল,
“মেহের ঠিক বলেছে ফাহমিদা। এতদিনের অভিমান কি সহজে শেষ হবার? সময় লাগবে। ভেঙে পড়ো না।”
দুপুরের দিকে মেহের ফায়াজকে ফোন করল। দু’বার রিং হবার পর ফায়াজ কল রিসিভ করল।

ফায়াজ রিসিভ করে হ্যালোও বলল না। মেহের ফায়াজের নীরবতায় নিজেও কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বলল,
“ফায়াজ খেয়েছো?”
মেহেরের শুকনো মুখে বলা কথাটা ফায়াজের হৃদয়ে শীতল অনুভূতি বইয়ে দিল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
“না, খাবো। কাজ ছিল একটু।”
মেহের বুঝতে পারছে না এত বেলা পর্যন্ত কি এমন কাজ।
“আচ্ছা খেয়ে ফোন করো। খেয়ে নেও তাড়াতাড়ি প্লিজ।”
ফায়াজ ছোট করে হুম বলল। মেহের ফোন কেটে দিল। ফায়াজ তবুও ফোনে কান পেতে রাখল। তারপর কান থেকে ফোন নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ফায়াজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়িতে ফিরছে। ভেতরে ঢুকার সময় খিলখিল হাসির শব্দ কানে ভেসে আসল। যেন বাড়ির ভেতরে উৎসব চলছে।
ফায়াজ ভেতরে এসে দেখে মেহের আর ফাইজা কিছু একটা নিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশে ওর মাও বসে হাসছে। কিন্তু ওদের মতো না। মৃদু ভাবে হাসছে। ফায়াজ মায়ের সে হাসি এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিল। ফায়াজের মা ছেলেকে দেখে হাসি থামিয়ে দিল। ফাইজা আর মেহের তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফায়াজকে উপরে যেতে দেখল।

রাতে ডিনার শেষে ফায়াজ ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। কাজে মন বসাতে পারছে না। ও ছোট থেকেই এমন। যতক্ষণ পর্যন্ত মনের মতো কিছু না হয় শান্তি নেই। এখনও তাই।
মেহের ফায়াজকে উসখুস করতে দেখে বলল,
“কি হয়েছে মুখ ভার করে রেখেছো কেন?”
ফায়াজ উত্তর দিল না। মেহের দুপা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কষ্ট পাচ্ছো তো? কি দরকার ছিল সকালে অমন একটা কাজ করার? তুমি জানো মা কত কষ্ট পেয়েছে?”

ফায়াজ মেহেরকে একবার চোখ তুলে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না।
মেহের আবারও বলল,
“তুমি যদি ভেবে থাকো উনাকে এ বাড়িতে এনে কষ্ট দেবে তাহলে ঠিক করো নি। তোমার মা উনি।”
ফায়াজ ল্যাপটপ অফ করে উঠে দাঁড়াল। মেহেরের বরাবর দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে গম্ভীর ভাবে বলল,
“তুমি কি উনার জন্য আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছো? আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইছো?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ তখনও ওর দিকে বাজপাখির দৃষ্টি দিয়ে আছে। মেহের আলতো করে চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ সেভাবেই চেয়ে আছে। হয়তো উত্তর জানতে চাইছে। মেহের থমথমে মুখে বলল,
“ঠিক আছে এ নিয়ে আমি আর কখনো কোন কথা বলব না।”
মেহেরের চোখ ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এখনি অশ্রু হয়ে ঝড়বে।
ফায়াজের মা বাইরে থেকে সবটা শুনল। তিনি এসেছিলেন মেহেরের কাছে। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে সবটা শুনে সেখান থেকেই ফেরত গেল।
মেহের বারবার চেয়েও নিজের জলভর্তি টলমলে চোখ আড়াল করতে পারছে না। ফায়াজ যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে আর চেয়ে আছে তাতে নিজেকে আড়াল করার জো নাই।

“এই যে কিছু বললেই চোখে পানি এসে পড়ে। কিছুই বলা যাবে না। শাসন করা যাবে না, কড়াভাবে কথা বলা যাবে না। ডু ইউ হেভ এনি আইডিয়া আমি কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি? কি চলছে আমার ভেতর? সে খোঁজ রেখেছো?”
এ-সব শুনে মেহেরের চোখের পানি আহ্লাদী হয়ে গেল। চোখের পাতা ভিজিয়ে পানি পড়ছে। ফায়াজ ওকে বকছে যে। মেহের একটু সরে যেতে নিল। ফায়াজ ওর হাত চেপে ধরে।
“তুমি কাঁদছো কেন? আমি কাঁদার মতো কি বললাম? আমি তোমাকে বকাবকি করেছি? সিম্পল ভাবে কয়েকটা কথা বলেছি। আমি কি দুটো কথা বলতে পারব না?”
মেহের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফায়াজের আর সাধ্য নেই মেহেরের উপর রাগ করে কিংবা দু-চারটা কড়া গলায় কথা বলে।
“আচ্ছা ঠিক আছে। আর বকব না।”
ফায়াজ মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সকাল থেকেই কেমন ব্যবহার করে যাচ্ছো। ভালো করে কথা বলছো না। এখন মুখ ভার করে বসে আছো। আর আমার উপর রাগ ঝাড়ছো।”
ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি জানো না মেহের আমি কতটা প্রেশারে আছি। কতটা টেন্স আছি। পুলিশ এখনো খুঁজে বের করতে পারে নি কালপিটটাকে।”
মেহের শান্তনা দিয়ে বলল,

“পেয়ে যাবে। চিন্তা করছো কেন?”
“পেয়ে যাবে? কবে পাবে?”
মেহের কনফিউজড হয়ে বলল,
“আমি কি করে বলব?”
ফায়াজ কটাক্ষ দেখিয়ে বলল,
“তাহলে বলো না। সবার একি কথা পেয়ে যাবে। কিন্তু কবে? কেউ জানে না। না জানলে বলার কি দরকার? আমি শান্তনা চেয়েছি?”
মেহের বুঝতে পারছে পাগল ক্ষেপেছে।
“আমি জানি তোমার টেন্সের কিছুটা কারণ আমি। কিন্তু আমি কি করব? কি করতে পারি?”
ফায়াজ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“তুমি কি করতে পারো। হ্যা তাই তো। তুমি পারো শুধু আমার মা-বোনের সাথা আড্ডা দিতে।”
“কি অদ্ভুত কথাবার্তা! আমি আজকাল বাড়িতেই থাকি। আর বাড়িতে থাকলে বাড়ির মানুষের সাথে মিশতেই হবে। তুমি আমাকে কারো সাথে মিশতে মানা করছো?”
ফায়াজ কন্ঠস্বরে স্বাভাবিকতা এনে বলল,

“না। আমি তা বলি নি। আমি এসেছি আমাকে দেখো নি? অবশ্যই দেখেছো। জলজ্যান্ত একটা মানুষ তোমাদের সামনে দিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই দেখেছো। তোমার উচিত ছিল না একবার আসা। আমি রুমে এলাম৷ ফাঁকা, কেউ নেই। ভাবলাম ফ্রেশ হয়ে নেই আসবে। ফ্রেশ হয়ে বের হয়েও রুম ফাঁকা। তারপরও মনকে শান্তনা দিলাম আসবে। হ্যা এসেছে প্রায় এক ঘন্টা পরে। এসেই বইপত্র নিয়ে পড়তে বসে গেলে। একবার আমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলে না। সারাদিন অফিসে খাটাখাটুনি করছি। অজ্ঞাত ব্যক্তিকে নিয়ে টেনশন করছি। সর্বোপরি বিরক্ত হয়ে পড়ছি। আমি কি আশা করতে পারি না বাড়িতে ফিরে বউয়ের হাসিমুখ দেখে ক্লান্তি দূর করব, বউ একটু হেসে হেসে আদুরে কন্ঠে দু’চার কথা জিজ্ঞেস করবে। না-কি এতটুকুও আশা করতে পারি না? সারাদিন তো বাড়িতে থাকি না এতটুকু সময় কি আমাকে দেওয়া যায় না? এতটুকু সময়ের তো সবটুকু চাই নি। সামান্য একটু। বাকি সময় যা খুশি করো। কিন্তু আমি অফিস থেকে ফিরে তোমাকে আমার ঘরে চাই।”

মেহের মনে মনে অনুতপ্ত হচ্ছে। আসলেই আজকাল ফায়াজের খোঁজ খবর রাখছে না, খেয়াল রাখছে না। পাগলামিও করছে না। ফায়াজের অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত। এতে কোন অপরাধ নেই।
মেহের অনুতাপের সুরে বলল,
“তোমার অভিযোগ পুরোপুরি সত্যি। আমি আসলেই আজকাল আমার দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। তোমার দুঃখে শরিক না হয়ে নিজেকে নিয়ে আছি। তোমার প্রতি যত্নশীলও নই। পরবর্তী থেকে এমন হবে না।”
“মেহের, তোমার খারাপ লাগলে সরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু তুমি জানো আমি যা অনুভব করি তাই বলি। আমি তোমার অভাববোধ করছি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি তোমার তীব্র অভাব অনুভব করি।”
মেহের ফায়াজের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার খারাপ লাগে নি। কষ্টও পাই নি। সব নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে যাকে ঘিরে আমার সব তার খবর রাখছি না। এটা অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।”
ফায়াজ বাঁকা হেসে বলল,

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৫

“অন্যায়ের শাস্তি হওয়া দরকার।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। কিন্তু ফায়াজ ছাড়ার পাত্র নয়৷ মেহেরকে কোলে তুলে নিল। চোখে-মুখে চুমু খেতে খেতে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

পরের দিন মেহের খেয়াল করল ওর শাশুড়ী মা আর আগের মতো কথা বলে না, ডাকে না। আগের মতো হাসিখুশীও না। কেমন মন মরা হয়ে থাকে।
ফায়াজ নিচে নামার সময় দেখে ওর মা সিড়ির একটা রেলিঙ প্রাণপণে ধরে আছে। নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। চোখ জড়িয়ে আসছে। ফায়াজ মা বলে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে ধরে। ওর মার চোখ বুজে আসছে। শরীরের ভার রাখতে পারছে না। ফায়াজ চিৎকার করে মেহের আর ফাইজাকে ডাকল।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.