শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৭
ফাবিহা নওশীন
“প্রেশার একদম লো। এই অবস্থা কি করে হলো? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে না না-কি?এভাবে চললে কি মানুষ বাঁচে? এমন অনিয়ম কেউ লক্ষ্য করে নি? উনাকে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এই বয়সে শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে বুঝেন ই তো। আমি মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। খাওয়াদাওয়ার প্রতি যত্ন নিবেন। শরীরের যে কন্ডিশন তাতে অতিরিক্ত চিন্তা করা যাবে না। খেয়াল রাখবেন।”
ডাক্তার ফায়াজের বাবাকে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলল।
ফায়াজের বাবা স্ত্রীর মুখের দিকে একবার চেয়ে ডাক্তারকে বলল,
“জি খেয়াল রাখব।”
ডাক্তার আরো নানা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। ফায়াজ সবার অগোচরে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। কেউ খেয়াল না করলেও মেহের ঠিকি খেয়াল করেছে।
মেহের দূর থেকে দেখল ফায়াজ বাগানে ঘাসের উপর পা দিয়ে কি জানি করছে। মনে হচ্ছে জুতো দিয়ে আকিঝুকি করছে।
ফায়াজ জানে ওর মা’য়ের অসুস্থতার কারণ ও নিজে। পরোক্ষভাবে কম অপমান, অবহেলা তো করে নি। হয়তো এজন্য অভিমান করে খাওয়াদাওয়া ছেড়েছে। নিজের যত্ন নেন না।
মেহের পেছনে থেকে নিঃশব্দে ফায়াজের কাঁধে হাত রাখল। ফায়াজ চমকালো না, আশ্চর্যও হলো না। এমনকি পেছনেও ঘুরল না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
মেহের ফায়াজের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“একটা কথা বলব? সেদিন তোমাকে বলেছিলাম আমি আর কখনো এ নিয়ে কথা বলব না। কিন্ত না বলে থাকতে পারছি না। খুব বলতে ইচ্ছে করছে। বলব?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
মেহের ফায়াজের পারমিশনের জন্য অপেক্ষা করছে। ফায়াজ বুঝতে পারল মেহেরকে পারমিশন না দিলে বলবে না।
ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল,”হ্যাঁ বলো।”
ফায়াজের পারমিশন পেয়ে মেহের দ্রুত বলল,
“তুমি যেদিন নাস্তা না করে চলে গেলে তার পরের দিন থেকে মা বদলে যেতে শুরু করল। আমার সাথে আগের মতো কথা বলতো না, নিজে খেতে ডাকত না। কোনকিছু নিজ থেকে বলতো না। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা ছোট করে উত্তর দিতো। বাড়তি কথা বলতো না। আগের মতো আমাকে আদর করে খাওয়াতো না। তার কাজেও অনেক গাফিলতি দেখেছি। মা যথেষ্ট পরিপাটি টাইপের। তিনি রুটিন অনুযায়ী সব করতেন। সময়ের হের ফের হতো না। কিন্তু ইদানীং তিনি কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে। সময় মতো কিছুই করত না। না খেতো না ঘুমাতো।”
ফায়াজ ছোট করে বলল,”ওহ! আচ্ছা।”
মেহের ফায়াজের উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না। একটা চাপা অসন্তোষ কাজ করল। মেহের ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
তারপর মোলায়েম গলায় বলল,
“তুমি আমার কাছে খোলা বইয়ের মতো। তোমার এই ছোট উত্তরের মাঝে যে বড়সড় আর্তনাদ আঁটকে আছে সেটা আমি জানি। তাই বৃথা নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করো না। আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের ফায়াজকে পরম ভালোবাসায় আগলে নিল।
“মেহের, এ-সব কার জন্য হয়েছে আমি জানি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। যাদের আঙুল ধরে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে শিখেছি, যাদের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি, যাদের অজস্র রাতের ঘুম নষ্ট করেছি, যারা হাসতে শিখিয়েছে তাদের কি করে এত কষ্ট দিলাম?”
মেহের ফায়াজকে সোজা করে গালে হাত রেখে বলল,
“এখনো সময় আছে।”
“কোন মুখে আমি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াব?”
মেহের স্মিত হেসে বলল,
“বাবা-মা কখনো তার ছেলে-মেয়েকে ফেলে দিতে পারে না। সন্তান যত ভুল করুক না কেন বাবা-মা বুকে জড়িয়ে নেয়। বাবা মা’কে খুব ভালোবাসে আর মা’য়ের এ অবস্থার কারণ তার অজানা নয়। তবুও তোমার দিকে আঙুল তুলে নি। একটা প্রতিবাদ বাক্য করে নি। কারণ কি জানো এই পৃথিবীর প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে সন্তান অমূল্য সম্পদ। সন্তানকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন৷ তাদের অবস্থান সবার উর্ধ্বে। যেখানে নিজেদের বড় বড় আঘাত কিছুই না সেখানে সন্তানের সামান্য কষ্টে বাবা-মায়ের কলিজা পুড়ে যায়। এখন বুঝতে পারছ না তো! একদিন বুঝবে যেদিন তুমি নিজে বাবা হবে।”
ফায়াজ চমকে মেহেরের দিকে তাকাল। ও কোনদিন বাবা হবে? হ্যা হবেই তো। ওর ও তো একদিন ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে। আদর ভালোবাসায় বড় হবে। সেদিন কি পারবে সন্তানের দেওয়া কষ্ট মেনে নিতে? ফায়াজ আর কষ্ট দেবে না ওর বাবা-মাকে। আজ থেকে বাবা-মাকে আগলে রাখবে।
ফায়াজ মায়ের ঘরের দরজা খুলল। ভেতরে হালকা আলো জ্বলছে। ফায়াজ ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল। ওর মা বিছানার সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে। গায়ে ধূসর রঙের একটা চাঁদর। ফায়াজ বিছানার পাশে গিয়ে বসল। দু-হাত বিছানার উপরে রেখে মাথা নিচু করে বসে রইল। নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
“ফায়াজ!” শীতল কন্ঠস্বর শুনে ফায়াজ মাথা উচু করল।
দ্রুত চোখের পানি মুছে বলল,
“হ্যাঁ মা।”
হ্যাঁ মা বলে ফায়াজ নিজেই চমকে গেল। ফায়াজের মা ফায়াজের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এতদিন পরে ছেলের মুখে মা ডাক শুনে কলিজা জুড়িয়ে গেল। বুকের ভেতর যে হাহাকার ছিল তা যেন নিমিষেই পানি হয়ে গেল৷ খুশির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে হৃদয় জুড়ে। ঠোঁট কাঁপছে। চোখে পানি জড়ো হয়েছে।
ফায়াজ অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আছে।
ফায়াজের মুখে মা ডাক শুনে ওনার শরীর খারাপ যেন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেল। শান্তি লাগছে খুব। তিনি উঠে বসলেন। ফায়াজ বাঁধা দিতে চেয়েও পারল না।
ধীরে ধীরে ফায়াজের হাতের উপর হাত রাখল। ফায়াজের শরীরে কম্পন বয়ে যাচ্ছে। ফায়াজ আচমকা মায়ের হাত ধরে কাঁদতে লাগল।
ফায়াজের মা বিচলিত হয়ে বলল,
“ফায়াজ, বাবা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? কেউ কিছু বলেছে? তোমার বাবা বকেছে?”
যেন ছোট বাচ্চা বাবার কাছে বকুনি খেয়ে মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে নালিশ দিচ্ছে এমন ভাব। মায়ের কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না। সেটা মায়ের উদ্ভব কথায় প্রকাশ পেল।
ফায়াজ হাতের উপর মাথা রেখে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করো মা। রাগের বশে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো। আমি অনেক খারাপ মা। তোমার খারাপ ছেলে।”
ফায়াজের মা ওর মুখ তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কে বলেছে তোমাকে তুমি খারাপ? তুমি আমার কলিজার টুকরো। আমার ছেলে।”
“আমাকে একটু আদর করবে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? আমি না এগুলো খুব মিস করি। ঠিক করে মনে করতে পারি না। কবে আমি শেষ এই আদর পেয়েছি তোমার কাছ থেকে।”
“হ্যা করব আদর। আজ আমি আমার ছেলেকে প্রাণভরে আদর করব।” চোখের পানি মুছে ফায়াজের মাথা কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর এটা সেটা বলছে।
কিছুক্ষণ পরে ফাইজা আর মেহের দরজায় উঁকি দিচ্ছে আর ফিসফিস করছে।
“এই বিচ্ছুরা চোরের মতো দরজার সামনে উঁকিঝুঁকি না করে ভেতরে আয়।”
মেহের আর ফাইজা দাঁত কেলিয়ে ভেতরে ঢুকল। ফাইজা ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যে একটা মেয়ে আছি সেটা তো ভুলেই গেছে বুড়ো খোকাকে পেয়ে।”
মেহের চোখ উল্টিয়ে চেয়ে বলল,
“আর আমি তো পরের মেয়ে।”
ফায়াজের মা ভ্রু কুচকে তাকাল। তারপর বলল,
“হয়েছে হিংসুকের দল। আয় তোরাও আয়।”
ফাইজা আর মেহেরও গিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহের সুযোগ বুঝে ফায়াজকে চিমটি কাটল। ফায়াজের মা দোয়া করল,
“হে আল্লাহ! আমার তিনটা সন্তানকে এভাবেই হাসিখুশি রেখো।”
মেহের ঘরে এসে উচ্ছ্বাসের সাথে ফায়াজকে বলল,
“আজকে যে আমি কি পরিমাণ খুশি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। খুশিতে আমার নাঁচতে ইচ্ছে করছে।”
ফায়াজ ব্যঙ্গ করে বলল,
“নাচো৷ অনেক দিন তোমার নাচ দেখি না। আজ দেখিয়ে মন শান্তি করো।”
মেহের ভেংচি কেটে বলল,
“শখের দেখছি কমতি নেই।”
ফায়াজ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“মজা করছি না। আ’ম সিরিয়াস।”
“আমার কাজ আছে। এসবের টাইম নেই।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“দু’জন একসাথে।”
মেহের ভ্রু কুঁচকে ফায়াজের দিকে চেয়ে ভাব দেখিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। আজ এত ভালো একটা কাজ করেছো। ওকে।”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর অল্প সাউন্ড দিয়ে গান ছেড়ে মেহেরের সাথে তালে তাল মিলাচ্ছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে আজ ও পরিপূর্ণ। সব আছে ওর।
“তুমি আমার জীবনের লাকি চার্ম মেহের। তুমি আসার পর থেকে আমার এলোমেলো জীবনটা পূর্ণতা পাচ্ছে। এক এক করে সব ফিরে পাচ্ছি। সবার প্রথমে নিজেকে পেয়েছি। নিজের ভেতরটা চিনেছি। তোমাকে আমি সারাজীবন আগলে রাখব। সীমাহীন ভালোবাসা দেব।”
।
কিছুদিন পরে মেহেরের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা ঘনিয়ে এল। ফায়াজ মেহেরকে একদিনের জন্য একা ছাড়ে নি। রোজ পরীক্ষার হলে আনা নেওয়া করত। ওর ফ্রেন্ডদের ওর সাথে থাকার জন্য বলত। সামিরা মেহেরকে এক মিনিটের জন্য একা ছাড়ে নি। ফায়াজের কড়া নির্দেশ। ঠিক নির্দেশ নয় অনুরোধ। ফায়াজ সেদিন অনেক অনুনয় করেছে। বন্ধুর জন্য এটুকু করতে পারবে না? মেহেরর সাথে এতদিন হোস্টেলে এক সাথে থেকেছে, ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠেছে।
এভাবে পরীক্ষা শেষ করে মেহের স্বস্থির নিশ্বাস নিয়েছে।
আজ মেহেরের ২২তম জন্মদিন। মেহের বাচ্চাদের মতো জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চায় নি কিন্তু ফায়াজ নাছোড়বান্দা। তাই মেহের মত দিয়েছে। তবে শর্ত দিয়েছে পার্টিতে শুধু দুই ফ্যামিলি আর ওদের কিছুসংখ্যক বন্ধু থাকবে। ফায়াজ তাতেই রাজী হয়েছে।
মেহের আজ শাড়ি পড়েছে৷ সোনালী পাড়ের নেভি ব্লু শাড়ি। ফায়াজ ব্লু স্যুট। হুট করে সব আলো নিভে গেল। মেহের ভয়ে ফায়াজের হাত চেপে ধরে বলল,
“লাইটের কি হলো?”
ফায়াজ হাত ছাড়িয়ে বলল,
“বাইশ বছর হয়ে গেছে তবুও বাচ্চাদের মতো ভয় পাও?”
মেহের কিছু বলতে যাবে তখনই মৃদু আলো জ্বলে উঠে। বড় একটা স্কিন ভেসে আসছে। আর সেখানে মেহেরের ছোট বেলার একটা ছবি। দুই ঝুটি করা। ফ্রক পরা, ফোকলা দাঁতের হাসি। মনে হয় সবে দাঁত পড়েছে।
তারপর একে একে ফায়াজের সাথে ওর যত ছবি। ওদের ভালোবাসা, রাগ, অভিমান সব কিছু ক্যামেরা বন্ধি করেছে। শেষে লিখা #মেহেরাজ
মেহের মৃদু হেসে বলল,
“#মেহেরাজ।”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৫৬
মেহের খুশিতে কেঁদে দিবে অবস্থা। তারপর দু’জন মিলে কেক কাটল। নাচ গান, আড্ডার মাধ্যমে জন্মদিনের পার্টি শেষ হলো।
মেহের ফায়াজের নাম লিখা একটা বক্স পেল। কৌতূহল বশত হাতে নিল। ফায়াজ সকাল সকাল অনেক গিফট দিয়েছে এখন আবার এই বক্স কিসের জন্য বুঝতে পারছে না। এত গিফট দিয়ে কি করবে।
মেহের কৌতূহল নিয়ে বক্সটা খুলল। বক্স খুলতেই চিৎকার করে বক্স ফেলে দেয়। মেহের বুকে হাত দিয়ে হাপাচ্ছে। ভয় পেয়ে গেছে খুব।
ফায়াজ চিৎকার শুনে দৌড়ে এল।
মেহের ফায়াজকে দেখে রেগে গিয়ে বলল,
“এসব কি? এগুলো কি ধরনের মজা?”
ফায়াজ মেঝেতে চেয়ে দেখে একটা পুতুল পড়ে আছে। হাত দিয়ে তুলে নিজেই চমকে গেল। কি ভয়ানক পুতুল।
মেহের বলল,”এটা কি ধরনের গিফট? এটা আমাকে ভয় দেখানোর জন্য দিয়েছো?”
ফায়াজ বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমি? আমি তো এটা আনি নি।”
Ai golpo r prottekta ta part khub khub khub sundor khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub khub valo lage